সর্বশেষ
রাজধানীতে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ আগামীকাল
মাহিয়া মাহির ৩০ সেকেন্ডের ভিডিও ভাইরাল
সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে জড়িয়ে ৬ ভুল তথ্য
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির শপথ গ্রহণ
আ.লীগের বিচার ও সংস্কারের আগে কোনো নির্বাচন হবে না
আ. লীগের নিবন্ধন বাতিল করে সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে: নাহিদ
পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে খাদ্য মজুতের নির্দেশ
মোহাম্মদপুরে পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার ৮
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ নিয়ে কাজ করা নারীদের স্বীকৃতি দিতে হবে: উপদেষ্টা
রাখাইনে শতশত বস্তা ইউরিয়া সার পাচার করছিল চক্রটি
এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পেতে বিলম্ব হলে বাংলাদেশ বিমানেই ফিরবেন বেগম খালেদা জিয়া
স্বামীকে রেখে দেবরের সঙ্গে পালালেন স্ত্রী, অতঃপর…
বৃষ্টির মধ্যেই তাপমাত্রা নিয়ে দুঃসংবাদ
সরকারি ব্যাংকে ষষ্ঠ-নবম-দশম গ্রেডে বিশাল নিয়োগ, পদ ৬০৮
এশিয়া আসছে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা, জেনে নিন কখন কার সঙ্গে খেলা

লুম্বিনীতে মায়াদেবীর পবিত্র আঁতুড়ঘরে

অনলাইন ডেস্ক

লুম্বিনী। ভগবান তথাগত বুদ্ধের আঁতুড়ঘর। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র ও কাঙ্ক্ষিত। অন্যদের কাছেও সমান আদৃত! তীর্থ যে ধর্মেরই হোক, তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অস্বীকার করার জো নেই।

আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের কথা। শাক্য রাজা শুদ্ধোধন আর মায়াদেবীর সংসারে শান্তি-সমৃদ্ধির কমতি নেই। রাজার রাজত্বে অনুগত প্রজা আছে, সম্পদ-ঐশ্বর্য সবই আছে, নেই শুধু রাজপুত্র। উত্তরাধিকারের উৎকণ্ঠা সবার মনেই। এর মধ্যে একদিন স্বপ্নে মায়াদেবী দেখা পেলেন এক শ্বেতহস্তীর।

কপিলাবস্তু থেকে পিতার রাজ্য দেবদহ অভিমুখে যাওয়ার পথে রুম্মিন-দাই তথা লুম্বিনীতে থামেন মায়াদেবী। বাঙালি মেয়েদের মতো প্রথম সন্তান জন্মদানের আগে মেয়েদের বাপের বাড়িতে যাওয়ার প্রথা তখনো ছিল কি না, তার হদিস কে দিতে পারে! এখানেই এক শালগাছের তলায় জন্ম নেন মায়াদেবীর অতি প্রতীক্ষিত সন্তান। তাঁর জন্মের মধ্য দিয়ে মা–বাবার মনষ্কামনা সিদ্ধ হওয়ায় সন্তানের নাম রাখা হয় সিদ্ধার্থ।

অবশ্য এই ধরাধামে সন্তান জন্মদানের আনন্দ বেশি দিন উপভোগ করতে পারেননি মায়াদেবী। সিদ্ধার্থর জন্মের সাত দিনের মাথায় তাঁর মৃত্যু হয়। মায়াদেবীর শেষ অনুরোধ রক্ষার্থে তাঁরই ছোট বোন মহাপ্রজাপতি গৌতমীকে বিয়ে করেন রাজা শুদ্ধোধন। গৌতমীর সন্তান বলেই রাজকুমার সিদ্ধার্থর অপর নাম হয় গৌতম।
আড়াই হাজার বছর পর গৃহত্যাগী সাধুর জন্মস্থান দেখতে এসেছি আমরা তিন গৃহী।

বাকি দুই সঙ্গী ফরহান ভাই আর তানভীর ভাই পুরোপুরি সংসারের ছড়ানো জালে জড়িয়ে গেলেও আমি মাঝেমধ্যেই হিমালয়ের নানা পর্বতে ক্ষেত্র–সন্ন্যাস নিয়ে থাকি! অন্নপূর্ণা রিজিয়নের এক পর্বত অভিযান থেকে বেসিশহর হয়ে কাঠমান্ডুতে ফিরেই আবার লুম্বিনীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছি তিনজন। নেপালের অসংখ্য বাস-ট্রাকের গায়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা থাকে ‘বুদ্ধ ওয়াজ বর্ন ইন নেপাল’। তেমনই বাণীখোদিত এক বাসে চেপে অক্টোবরের এক ভোরে লুম্বিনীর মনাস্ট্রিক জোনের অসংখ্য প্রবেশদ্বারের একটিতে নেমে পড়লাম।

মূল বিহার চত্বরে ঢোকার মুখেই লালচে এক শিলায় খোদিত আছে পঞ্চশিলা। বোধিবৃক্ষের তলায় বসে সামনের পবিত্র পুকুরের জলে মায়াদেবী মন্দিরের প্রতিফলন দেখতে দেখতে অপেক্ষা করলাম ভিড় কমার। সন্তান জন্মদানের আগে এই টলটলে জলের পুকুরে স্নান করেন মায়াদেবী। সাদা দালানের ওপর সোনালি চুড়োর মূল মন্দিরে প্রবেশের আগে নজরে এল ‘নো টিকটক’ সাইনবোর্ড। অবশ্য একে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নর্তন–কুর্দনে পিছিয়ে নেই নারী-পুরুষেরা। নেপালে সর্বত্র এই মহামারি অ্যাপের জয়জয়কার!

কাঠের তৈরি একটি প্যাঁচানো ওয়াকওয়ের শেষ মাথায় সেই মোহনীয় কালো পাথর। ভগবান তথাগত এখানেই মায়ের জঠর ছেড়ে ধরাধামে এসেছিলেন। পাথরটি আচ্ছাদিত আছে বুলেটপ্রুফ কাচে। পাশেই দাঁড়ানো আছেন রাইফেল হাতে প্রহরী। সেকেন্ড বিশেকের ঝাঁকিদর্শন শেষে পা চালাতে হয় ওয়াকওয়ে ধরে। বিশ্বের মোটামুটি সব দেশের মুদ্রা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে কাঠের ওয়াকওয়েটির নিচের অংশে। নিজ নিজ দেশের মুদ্রা ছুড়ে গেছেন বিশ্বের দূরতম প্রান্তের অধিবাসীরাও। তথাগতর সুদৃষ্টি পাওয়ার আশায়ই এসব মুদ্রা ছড়ানো হয়েছে কি না কে জানে!

মায়াদেবীর মন্দির লাগোয়া অশোক স্তম্ভের অবস্থান। বুদ্ধের মহানির্বাণের দুই শতাব্দী পরে লুম্বিনীতে আসেন মৌর্য সম্রাট অশোক। ভগবান তথাগতর জন্মস্থান চিহ্নিত করে সেখানে পাথর স্থাপন করেন তিনি। শিলাটির অদূরেই তৈরি করা হয় অশোক স্তম্ভ। পুণ্যভূমি হিসেবে লুম্বিনী প্রতাপশালী সম্রাট কর্তৃক চিহ্নিত হওয়ায় তৎকালীন লুম্বিনী গ্রামের অধিবাসীদের খাজনা আটভাগের একভাগ করে দেওয়া হয়! এ ছাড়া যেখানে যেখানে বুদ্ধের স্মৃতি আছে, তিনি সেখানেই বিহার নির্মাণ করেন। আমাদের দেশেও রামুর রাংকূট বিহারে আছে সেই নিদর্শন।

চতুর্দশ শতকে নেপালের বিখ্যাত মাল্লা রাজবংশের রাজা রিপু মাল্লা আসেন লুম্বিনীর এই তীর্থস্থান ভ্রমণে। অবশ্য সে সময় হিন্দু দেবী হিসেবে পূজিত হতেন মায়াদেবী। সনাতন ধর্মে বুদ্ধদেবকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে গণ্য করায় তাঁর মাতা হিসেবে মায়াদেবী নৈবেদ্য পান রুপাদেবী নামে। ১৮৯৬ সালে এই অশোক স্তম্ভ পুনরায় আবিষ্কৃত হওয়ার পর লুম্বিনী গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান হিসেবে আবার পাদপ্রদীপের আলোয় আসে। ছয় মিটার উঁচু গোলাপি বেলেপাথরের এই স্তম্ভ স্থাপনের এত বছর পরও এখনো নজর কাড়ে দর্শনার্থীদের।

এখান থেকে বেরিয়ে এবার মূল মনাস্ট্রিক জোনের দিকে পা বাড়ালাম। মূলত লুম্বিনীর এই বিশাল কমপ্লেক্স একটি আয়তক্ষেত্রের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে। আয়তক্ষেত্রের এক পাশে আছে মায়াদেবীর মন্দির আর অন্য পাশে আছে জাপানিদের তৈরি ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডা। এই দুই জায়গাকে কেন্দ্র করে চাক বেঁধেছে লোকের ভিড়। যাঁদের সময়ের পুঁজি অল্প, তাঁরা এই দুই পবিত্র স্থান দর্শন করে ফেরার পথ ধরেন। আমাদের হাতে লুম্বিনীর জন্য সময় বরাদ্দ দুদিন। হুড়োহুড়ির দুর্দৈব আমাদের নেই। অনেকেই গাড়ি ভাড়া করে পথ চললেও আমরা আস্থা রাখলাম নিজেদের পায়ের ওপর।

পদ্মপাতার ওপর দণ্ডায়মান শিশু সিদ্ধার্থর মূর্তি থেকে এগোলে সরলরেখার মতো সোজা ও বাঁকহীন এক জলাশয়ের দুধারে বিশ্বের নানা দেশের মনাস্ট্রি। জলাশয়ের একদিকে বৌদ্ধধর্মের প্রধান দুই শাখা—মহাযানপন্থীদের বিহার, অন্যদিকে থেরবাদপন্থীদের বিহার। আমরা তথাগতর শিক্ষা অনুযায়ী মধ্যপন্থা অবলম্বন করে কখনো জলাশয়ের এ ধারে, কখনো–বা ও ধারের বিহারে যাচ্ছি। যাত্রা শুরু করলাম মিয়ানমারের গোল্ডেন টেম্পল দিয়ে। পরের দুদিন ধরে লুম্বিনীর প্রতিটি মনাস্ট্রি ধীরপায়ে ঘুরে দেখেছি। সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে কম্বোডিয়ার মনাস্ট্রি। এত সূক্ষ্ম কারুকাজসংবলিত বিহার এই কমপ্লেক্সে বিরল। আমার কাছে যেকোনো দেবায়তনের স্থাপত্যরীতি বেশ গুরুত্ব বহন করে। সেদিক থেকে কম্বোডিয়ার পরই ঝেং হুয়া মনাস্ট্রি বা চানিজ বিহারের স্থান হবে। কোরিয়া আর ভিয়েতনামের দেবগৃহও অবশ্য স্থাপত্যের সৌন্দর্যে খুব একটা পিছিয়ে নেই। সিঙ্গাপুরের বিহারে গিয়ে দেখলাম পূর্ণোদ্যমে চলছে দেবচর্যা। বুদ্ধদেবের সুদৃষ্টি পাওয়ার আশায় পুণ্যপিপাসুরা নানা কিছু করছেন। আমরা অবশ্য দ্রষ্টা।

নেপালের থেরবাদ বিহারের পাশাপাশি এখানে আছে বজ্রযান বিহারও। মত আর পথ যতই ভিন্ন হোক, জাগতিক মোহ থেকে মুক্তি তথা মোক্ষলাভই সবার উদ্দেশ্য। বিহার দর্শনের ফাঁকে ফাঁকে চলছে সারসদর্শনও। লুম্বিনীর এই জায়গা যে লম্বা গলার পাখি সারসের অভয়ারণ্যও। বিহারগুলোর মাঝখানের ফাঁকা জায়গার জলাভূমিতে সহজেই এদের দেখতে পাওয়া যায়। সিদ্ধার্থর জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ধরে রাখা হয়েছে অনেকগুলো বিহারের দেয়ালেই। সুজাতা কর্তৃক ভগবান তথাগতকে পায়েস প্রদানের দৃশ্য মূর্ত আছে অস্ট্রিয়ান বিহারে। প্রতিটি বিহারেই সেই দেশে বৌদ্ধধর্মের স্বরূপ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এটা করতে গিয়েই বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের একটা চিত্তাকর্ষক মানচিত্রে পরিণত হয়েছে লুম্বিনীর কয়েক বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই কমপ্লেক্স।

সম্পর্কিত খবর

এই পাতার আরও খবর

সর্বশেষ