এবারের সপ্তম শ্রেণির নতুন একটি বইয়ে ‘লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে’ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও একই শ্রেণির একই বিষয়ের পুরোনো বইয়ে ৩০ লাখ শহীদের কথা বলা হয়েছিল। আবার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নতুন পাঠ্যবইয়ে ৩০ লাখ শহীদের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণির আরেকটি বই থেকে ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার, সাবেক তারকা ফুটবলার কাজী সালাহউদ্দিন ও জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানের ছবি বাদ দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের নতুন পাঠ্যবইয়ে এ রকমভাবে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। এসব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ভুল ও অসংগতিও চিহ্নিত হচ্ছে। কিছু কিছু ভুল সংশোধনও করেছে বিনা মূল্যের বই তৈরি ও বিতরণ সংস্থা এনসিটিবি।
বেশ কিছু গদ্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা বা বিষয়বস্তু বাদ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নতুন করে স্থান পেয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের বিষয়বস্তু। গল্প-কবিতা, সংকলন, ছবি ও গ্রাফিতির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, যেসব ভুল ধরা পড়ছে, সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে ওয়েবসাইটে পিডিএফ বা অনলাইন ভার্সনে সংশোধন করা হচ্ছে। আর যেসব বই ইতিমধ্যে বিদ্যালয়গুলোতে পাঠানো হয়েছে, সেখানে সংশোধনী পাঠানো হবে। কিন্তু যেসব বই এখনো ছাপানোর প্রক্রিয়ায় আছে, সেগুলো সংশোধন করে ছাপা হচ্ছে।
১ জানুয়ারি শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এবার নতুন শিক্ষাক্রম স্থগিত করে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের আলোকে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই দেওয়া হচ্ছে। এনসিটিবি ৪১ জন বিশেষজ্ঞ দিয়ে ৪৪১টি পাঠ্যবই পরিমার্জন করেছে। এতে অনেক বিষয়বস্তু সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। বেশ কিছু গদ্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা বা বিষয়বস্তু বাদ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নতুন করে স্থান পেয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের বিষয়বস্তু। গল্প-কবিতা, সংকলন, ছবি ও গ্রাফিতির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান।
এনসিটিবি সূত্রমতে, নতুন শিক্ষাবর্ষে চার কোটির মতো শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ৪০ কোটির বেশি বই ছাপানো হচ্ছে। যদিও শিক্ষাবর্ষের তিন সপ্তাহের বেশি পেরিয়ে গেলেও সারা দেশের সব শিক্ষার্থী সব নতুন বই পায়নি। এনসিটিবির ওয়েবসাইটে সব পাঠ্যবইয়ের পিডিএফ দেওয়া হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণির ইংলিশ ফর টুডে বইয়ে ‘স্পোর্টস পারসোনালিটি’ শীর্ষক একটি লেসন থেকে শচীন টেন্ডুলকার, কাজী সালাহউদ্দিন ও সাকিব আল হাসানের ছবি বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের স্থলে যথাক্রমে জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া, বাংলাদেশে দাবার কিংবদন্তি রানী হামিদ এবং বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতির ছবি স্থান পেয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা
এনসিটিবির সূত্রমতে, এবার ইতিহাসবিষয়ক বইগুলোতে বেশি পরিবর্তন করা হয়েছে। সপ্তম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম’ শীর্ষক অধ্যায়ের একাংশে লেখা আছে, ‘লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।’ তবে ২০২২ সালের (গত দুই বছর নতুন শিক্ষাক্রমের বই ছিল) এই পাঠ্যবইয়ে একই নামের অধ্যায়ে লেখা আছে, ‘…ফলে ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।’ অবশ্য তৃতীয় শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহিদ হন।’ চতুর্থ শ্রেণির পাঠ্যবইয়েও ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এবারের পাঠ্যবই পরিমার্জনের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাখো’ মানে তো লাখ লাখ। সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ‘লাখো’ শব্দটি বাক্যের ছন্দের সুবিধার্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণির ইংলিশ ফর টুডে বইয়ে ‘স্পোর্টস পারসোনালিটি’ শীর্ষক একটি লেসন থেকে শচীন টেন্ডুলকার, কাজী সালাহউদ্দিন ও সাকিব আল হাসানের ছবি বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের স্থলে যথাক্রমে জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া, বাংলাদেশে দাবার কিংবদন্তি রানী হামিদ এবং বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতির ছবি স্থান পেয়েছে।
ভুল, সংশোধন, বিতর্ক
নবম-দশম শ্রেণির ইংলিশ ফর টুডে বইয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে লেখা ‘গ্রাফিতি’ নামে একটি অধ্যায় যুক্ত হয়েছে। এই অধ্যায়ে গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদের নিহত হওয়ার তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৭ জুলাই। প্রকৃতপক্ষে এটি হবে ১৬ জুলাই। অবশ্য, বিষয়টি ধরা পড়ার পরপরই পিডিএফে সংশোধন করা হয়েছে।
এ ছাড়া পঞ্চম শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ শীর্ষক প্রবন্ধের একাংশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এসব নামের সঙ্গে ‘নাহিয়ান’ নামে একজনের নামও ছাপা হয়। পরে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া পাঠ্যবইয়ের অনলাইন সংস্করণে তা সংশোধন করে শহীদ নাফিসার নাম যুক্ত করা হয়েছে।
সর্বশেষ, আপত্তির মুখে নবম ও দশম শ্রেণির একটি পাঠ্যবইয়ে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দিয়ে পিডিএফে নতুন গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে সংঘাতের ঘটনা ঘটে।
এই অধ্যায়ে গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদের নিহত হওয়ার তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৭ জুলাই। প্রকৃতপক্ষে এটি হবে ১৬ জুলাই। অবশ্য, বিষয়টি ধরা পড়ার পরপরই পিডিএফে সংশোধন করা হয়েছে।
ইতিহাস বিষয়ে পরিবর্তন
এনসিটিবির পাঠ্যবই পর্যালোচনায় দেখা যায়, তৃতীয় শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে ‘আমাদের চার নেতা’ নামে নতুন একটি অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে। এই চার নেতা হলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গত বছর তৃতীয় শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে থাকা ‘আমাদের জাতির পিতা’ অধ্যায়টি এবারের পাঠ্যবইয়ে নেই।
নতুন পাঠ্যবইয়ে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি নতুনভাবে রাখা হয়েছে। ইতিহাসবিষয়ক একাধিক বইয়ে বলা হয়েছে, ‘২৬শে মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর তিনি ২৭শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবারও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।’
আগের বইয়ে ছিল, ‘বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে অর্থাৎ ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান প্রথম আলোকে জানান, এবার তাঁরা ইতিহাসবিষয়ক পাঠ্যবইয়ে ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস পর্যন্ত ইতিহাসের বিষয়বস্তুকে স্থান দিয়েছেন। তাই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিষয়বস্তু সাহিত্যের অংশ হিসেবে বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা হয়েছে। এবার ইতিহাসের বিষয়ে অতিবন্দনা বাদ দেওয়া হয়েছে। কাউকে ছোটও নয়, আবার কাউকে বড়ও নয়—এমনভাবে বিষয়বস্তু স্থান দেওয়া হয়েছে।