সাহিত্যে নোবেলজয়ী (২০১৫) বেলারুশি লেখক ও সাংবাদিক স্ভেৎলানা আলেক্সিয়েভিচ। সম্প্রতি লিথুয়ানিয়ার ভিলনিয়াস বইমেলায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন ৭৬ বছর বয়সী এই লেখক। লিথুয়ানিয়ার জাতীয় রেডিও এবং টেলিভিশন কেন্দ্রের (এলটিআর) সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন ইউক্রেন যুদ্ধ, ইউরোপ ও গণতন্ত্র নিয়ে। ভাষান্তর করেছেন এনামুল রেজা
lমনে হচ্ছে একদিন আমরা জর্জ অরওয়েলের বিশ্বে জেগে উঠব– যেখানে শান্তিই যুদ্ধ, যুদ্ধই শান্তি, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানদের বলা হচ্ছে স্বৈরশাসক, আর সত্যিকার স্বৈরশাসকরা যা চান তাই পাচ্ছেন। আপনার কী ধারণা, আসলে হচ্ছেটা কী?
llঅরওয়েল কীভাবে এমন নিখুঁত সব অনুমান করেছিলেন কে জানে। সোভিয়েত আমলে ৪০ বছরেরও বেশি কাটিয়েছি আমি, কিন্তু প্রথমবার অরওয়েল পড়ার অভিজ্ঞতা আমার জন্যও ভীতিকর ছিল।
আজ সারা দুনিয়া বদলে গেছে। কিন্তু ১৯৯০-এর দিকে আমরা এটা ভেবে খুশি হতাম যে সেখানে কোনো রক্তপাত ছিল না। রক্তপাত ছাড়াই আমরা সাম্রাজ্য পড়ে যেতে দেখেছি।
আমরা ছিলাম অতি সরল। ওই সময় যুদ্ধ হতো সাম্রাজ্যসীমার মধ্যেই, ভেবেছিলাম ব্যাপারগুলো ওভাবেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু না, কম্যুনিস্টরা মরে গেল, তারপরেও আবার সব শুরু হয়ে গেছে।
আমার ধারণা আমাদের কিছু একটা হয়ে গেছে, যা কেউই ব্যাখ্যা করতে পারছি না। ইতিহাসের সরলরৈখিক কোনো চেহারা আজ নেই। এখন ভবিষ্যতে কী হবে আগেভাগে বুঝে ওঠা অসম্ভব।
যুদ্ধটা যখন শুরু হলো, অনেকেই বলেছিল যে পুতিন ইউক্রেনের জনতাকে বোঝেননি, তাদের অবমূল্যয়ন করেছেন। এবং এখনও অনেকে বলছেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্টও বোঝেন না, ভাবেন যে উনি বলবেন, ‘বহুত হয়েছে, এইবার অস্ত্র নামাও’; আর এতেই সবাই তাঁর কথা মেনে নেবে। ইউক্রেনের জনগণ যুদ্ধের এই তিন বছরে কীভাবে বদলে গেছে?
আমি নিজে আধা ইউক্রেনীয়। আমার মা ইউক্রেনের মানুষ। এ দেশে অনেক বছর কাটিয়েছি, বিশেষ করে কৈশোরে। এ জনপদকে আমি সম্মান করি, তারা মাইদান-এর (ইউক্রেনে তৎকালীন সরকারবিরোধী গণআন্দোলন– ২০১৩, ২০১৪) মতো ব্যাপারকে সম্ভব করেছেন, যখন সারাবিশ্ব ভেবেছিল ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করবে, তখনই তারা নেমে এসেছিল স্বাধীনতার পথে; আত্মসমর্পণ করেনি।
তারপর এত বেশি রক্তপাত। আমি দেখতে চাই ইউক্রেনের সঙ্গে সমঝোতা সম্পন্ন হয়েছে। এ পর্যন্ত ট্রাম্প আর পুতিন যা কিছু করেছেন, এর কিছুই আমি বুঝিনি। ইউক্রেনে ঝরে যাওয়া রক্তের প্রতি তারা কেউই সম্মান দেখালেন না।
আমি এ দেশের লোকজনকে দেখে বিস্মিত হই। বহুদিন ধরেই একটা ব্যাপার ঠিক অর্চনার মতো হয়ে গেছে– যুদ্ধে মারা যাওয়া মানুষ বহনকারী কনভয়গুলো যখন ইউক্রেনের গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যায়, রাস্তার দু’পাশে যত লোক সবাই নতজানু হয়ে শ্রদ্ধা জানায়– বাচ্চারা দাঁড়িয়ে আছে; আছে বৃদ্ধ, তরুণ-তরুণী। না, এই মানুষেরা হারবে না। কিন্তু অপমানও তাদের প্রাপ্য নয়।
আমার ধারণা পশ্চিমা বিশ্ব অপরাধবোধে ভুগছে, কারণ ইউক্রেনকে তারা সময়মতো পর্যাপ্ত অস্ত্রের জোগান দিতে পারছে না এবং পুতিন গুছিয়ে নেওয়ার সময় পাচ্ছেন, সময় পাচ্ছেন প্রস্তুতির।
lআপনার কী মনে হয়, পশ্চিমা বিশ্ব পুতিনকে ভয় পায় কেন?
llপ্রথমত, পারমাণবিক বোমা ফেলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দেবেন– এমন একটা ভীতি তিনি তৈরি করে রেখেছেন। আমি ভবিষ্যৎবক্তা নই কিন্তু আমার মনে হয় না পুতিন এই ঝুঁকি নেবেন। ইউরোপজুড়ে কী পরিমাণ ব্যক্তিগত অর্থ ছড়িয়ে আছে তাঁর, কী পরিমাণ সম্পত্তি– আমি মনে করি না ওইসব খুব সহজে তিনি হারাতে চাইবেন। এবং হারাতে চাইবেন না তাঁর বন্ধুদেরও। কিন্তু এটা রাজনীতি, এক ধরনের জুয়ার মতো। এখন নতুন একজন খেলোয়াড়ও এসে গেছেন– ট্রাম্প এবং সব হিসাব ওলটপালট হয়ে গেছে।
lআপনি নির্দিষ্ট করে দু’জনের কথা বললেন– পুতিন ও ট্রাম্প, কিন্তু তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে দুটি জাতি, রাশান এবং আমেরিকান। লিথুয়ানিয়ায় কেউ কেউ বলেন, রাশিয়ার লোকজন পুতিনকে এবং এই যুদ্ধকে সমর্থন করেন। আবার আরেক দলের মতে, মানুষ এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পায়, কারণ এর আগে যারাই আওয়াজ তুলেছেন তাদের দমন করা হয়েছে। রাশিয়ার লোকজন প্রসঙ্গে আপনি কী বলবেন?
llপুতিন কী জিনিস সবাই জানেন। কিন্তু রাশিয়ার লোকজন জানে কিনা– এটা বড় প্রশ্ন। আমি মনে করি, এমন বহু মানুষ নিশ্চুপ হয়ে আছেন, যারা যুদ্ধটা চান না। তবে মুদ্রার অন্য পিঠও আছে। এমন একজনকে চিনি, যিনি বলে বেড়ান, ‘আমি গিয়ে খোখলদের এক হাত দেখে নেব’ (রাশিয়ায় ইউক্রেনীয়দের যে ব্যঙ্গাত্মক শব্দে ডাকা হয়)। যদি জানতে চাই, ‘কেন?’ উত্তর আসে, ‘ওদের দেখতে পারি না তাই।’
সাংবাদিক ভ্লাদিমির জোলকিন। যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে প্রচুর আলাপ করেছেন। সেখানে রাশান বন্দিরা ভয়ানক সব কথা বলেন। যেমন– একজন জানান, ‘পরিবারের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম যুদ্ধে যাব, কারণ টাকা লাগবে। গাড়িটা পুরোনো হয়ে গেছে, বাড়িটারও মেরামত দরকার।’
যখন জোলকিন এক বন্দিকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘তোমার বাবা-মা, স্ত্রীকে কল দাও’, ফোনের ওপাশ থেকে তাঁর স্ত্রী আর মা যা বলেছিলেন তা ভীতিকর। মাঝেমধ্যে এসব যুবক তাদের পরিবারকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, ‘মা, টিভিতে ওরা যা দেখায় সত্যি না। এখানকার লোকজন তো আমাদের মতোই।’ ওদের কারও স্ত্রী তখন ফোনের ওপাশ থেকে চিৎকার করেন, ‘মেয়েটা স্কুলে যাবে, ওর জন্য একটা ল্যাপটপ নিয়ে এসো।’
lমানুষের জীবন মূল্যহীন, যেখানে অর্থই সব কিছু?
llহ্যাঁ, বলতে পারেন পুতিন রাশানদের কিনে নিয়েছেন খুব সহজেই। আফগানিস্তান যুদ্ধে মৃত সোভিয়েত সৈনিকদের নিয়ে একটি বই লিখেছিলাম আমি। যাদের মায়েরা ছিলেন কম্যুনিজমবিরোধী, কম্যুনিস্ট নেতাদের বিরোধী, যুদ্ধের বিপক্ষে। পুত্রদের অর্জিত সামরিক পদকগুলো তারা জেনারেলদের মুখে ছুড়ে মেরে বলতে পেরেছিলেন, ‘রক্তের বিনিময়ে এসেছে এগুলো, আমরা এসব চাই না।’
এখন পদক মূল্যহীন। ওরা আপনাকে দেবে অল্প কিছু টাকা, চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন, তারপর আপনি পাবেন ‘কাজ’-এর বিনিময়ে অর্থ।
আপনার মনে আছে যখন রাশান সেনাবাহিনী ইউক্রেনে ঢুকেছিল, কেমন আচরণ করেছিল? ইউক্রেন থেকে রাশিয়ায় তাদের গাড়ির বহর, ট্যাঙ্কগুলো ফিরে এসেছিল একেকটা দোকান হয়ে, সেগুলো ভরা ছিল ওয়াশিং মেশিন, গালিচা, সব রকমের জিনিসপত্র দিয়ে। এক ভয়াবহ দৃশ্য ছিল সেটা।