পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যেন তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩) উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ মুসলমানের ওপর রোজা ফরজ করার ঘোষণা দিয়েছেন। কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব মুসলমানের জন্য এই আয়াত দলিল।
আল্লাহ সম্বোধন করেছেন, ‘হে মুমিনরা!’। এই সম্বোধনের পেছনে বিশেষ প্রজ্ঞা ও রহস্য আছে। কেননা রোজা এমন বিষয় যা মানুষের জন্য কষ্টকর ও কঠিন। এজন্য সত্সাহসের প্রয়োজন হয়। এজন্য রোজা ভিত রাখা হয়েছে ঈমানের ওপর। বলা হয়েছে, তোমরা যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছ, আল্লাহর সব কথা মান্য করার অঙ্গীকার করেছ, ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশ করেছ, নিজেকে আল্লাহর হাতে ন্যস্ত করেছ তাদের জন্য এই নির্দেশ।
এখানে বিবেচ্য নয় যে তাতে সেটা ভালো লাগবে কি না, তাতে পার্থিব কল্যাণ আছে কি না, তা সহজ হোক না কঠিন, মর্যাদা বেশি, না কম। আমরা যখন আল্লাহর দাসত্ব স্বীকার করেছি, তার দাসত্বের বেড়ি গলায় পরেছি এবং আনুগত্যের ঘোষণা দিয়েছি, তখন আমরা তিনি যে হুকুমই দেবেন আমাদের কর্তব্য তা মেনে নেওয়া। এজন্যই আল্লাহ মুমিন বলে সম্বোধন করেছেন।
আল্লাহ বলেছেন, ‘মুমিনরা তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর।’
ধর্ম ও নৈতিকতার ইতিহাসে, জাতি ও রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাস থেকে প্রমাণিত সব ধর্মে কোনো না কোনো রূপে রোজার বিধান আছে। ধর্ম ও ইতিহাস গ্রন্থে তার বিস্তারিত পাওয়া যাবে কোন পদ্ধতিতে কি পরিমাণ রোজার বিধান ছিল, কোন সময় শুরু হতো, কত সময় তাদের রোজা রাখতে হতো এবং কোন কোন বিষয়ে বিধি-নিষেধ ছিল।
এই আয়াতে আল্লাহ আরও বলেছেন, ‘যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ এই বাক্যে একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যখন কোনো ভাষার একটি শব্দ অন্য ভাষায় অনূদিত হয়, তখন তার মর্মার্থ হারিয়ে যায় এবং তা বুঝতে কষ্ট হয়। এমন দুটি শব্দ তাকওয়া ও মুত্তাকি।
ভারতীয় উপমহাদেশে মুত্তাকি শব্দ দ্বারা বোঝান হয় এমন ব্যক্তিকে যে অনেক ইবাদত করে, রাতে কম ঘুমায় বা ঘুমায় না, যে খুব সামান্য খাবার গ্রহণ করে, সব সময় ইবাদতে মগ্ন থাকে, বেশি বেশি নামাজ পড়ে, নামাজেই তার মন পড়ে থাকে, ইত্যাদি। কিন্তু আরবি ভাষায় তাকওয়া শব্দ দ্বারা বেশি বেশি ইবাদত ও রাত জাগরণকে বোঝায় না।
আরবদের কাছে মুত্তাকি (আল্লাহভীরু) সেই ব্যক্তি যে প্রতিটি কাজ করার সময় বিবেচনা করে, এই কাজটি কেমন হবে? বৈধ না অবৈধ? দ্বিনের অনুকূল না প্রতিকূল? তাকওয়ার অর্থ লজ্জা ও বিবেচনাবোধ। সুতরাং লজ্জা ও বিবেচনা মুমিনের অভ্যাসে পরিণত হওয়া প্রয়োজন। যদি ব্যক্তি সঠিক শিক্ষা পায়, ভালো পরিবেশ পায়, সঠিক পারিবারিক শিক্ষা পায়, তবে সে বড়দের শ্রদ্ধা করে। বড়দের শ্রদ্ধা করার অর্থ কি? অর্থ হলো তাদের সামনে এমন কোনো কাজ ও আচরণ না করা, বড়দের তাচ্ছিল্য ও বিদ্রূপ না করা। এমন ছোটদের ব্যাপারে বলা হয় সে খুব ভদ্র ও শিষ্ট। তাকওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ।
আল্লাহভীরু ব্যক্তি প্রতিটি কাজের শুরুতে ভাবে—কাজটি কেমন হবে? এতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবে, নাকি রুষ্ট হবেন? শরিয়ত কি কাজটি অনুমোদন করে, নাকি করে না। এই চিন্তা ও ভাবনার অভ্যাসের নাম তাকওয়া। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, তাকওয়া কাকে বলে? তিনি বলেন, হে আমিরুল মুমিনিন! ধরুন, আপনি এমন রাস্তায় চলছেন যার দুদিকে কাঁটাযুক্ত গাছ এবং রাস্তাও খুব সংকীর্ণ। ওমর (রা.) বলেন, আমার জীবনে এমনটি হয়েছে। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, তখন আপনি কি করেছিলেন? তিনি বললেন, কাপড় শামলে নিয়ে সাবধানে পথ চলেছি। যেন কাঁটায় কাপড় আটকে না যায়। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, এটাই তাকওয়া। জীবন এমনভাবে কাটানো যেন কোনো কাজে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়ে না যান।
তাকওয়া হলো একটি বোধ ও অভ্যাসের নাম। মুত্তাকির ভেতর লজ্জা ও বিবেচনা বোধ কাজ করে এবং সে বিবেচনার জায়গা থেকে সব কাজের বিচার করে।
তামিরে হায়াত থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার সংক্ষেপিত ভাষান্তর