সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারসহ ১১টি শিল্প গ্রুপের পাচারকৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং পাচারের টাকায় বিদেশে গড়ে তোলা বিপুল পরিমাণ সম্পদের হদিস মিলেছে।
এ কাজে পারদর্শী চারটি আন্তর্জাতিক সংস্থা তথ্য উদ্ধারে বড় সাফল্য পেয়েছে। এখন পাচারের অর্থ দেশে ফেরত আনার আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। অর্থ উদ্ধারে সম্পৃক্ত বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নগদ কোনো অর্থ দেওয়া হবে না। উদ্ধার করা অর্থ থেকে কমিশন দেওয়া হবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবার ছাড়াও পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্প গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে-সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আরামিট গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, সামিট গ্রুপ প্রভৃতি। এসব গ্রুপের মাধ্যমে পাচার করা অর্থের একটি অংশের সুবিধাভোগী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে কাজ করা আন্তর্জাতিক চারটি প্রভাবশালী সংস্থা হলো-দ্য স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি (এসটিএআর), ইন্টারন্যাশনাল এন্টি করাপশন কোঅর্ডিনেশন সেন্টার (আইএসিসিসি), যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাসেট রিকভারি (আইসিএআর)।
এ সংক্রান্ত একাধিক প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, তদন্তাধীন আলোচ্য ১১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টির বিষয়ে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা নিয়ে তদন্ত করে প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তবে সামিট গ্রুপের বিষয়ে এখনও তদন্ত চলছে। বাকিগুলোর ব্যক্তি ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে দেশি-বিদেশি ব্যাংকে থাকা অর্থ, বিদেশে বিনিয়োগ ও সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ১১টি ঘটনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের নামে দেশে ও বিদেশে অবৈধ সম্পদ চিহ্নিত করতে অনুসন্ধান চলছে। এতে প্রাপ্ত সম্পদের বিষয়ে আরও তথ্য ও দালিলিক প্রমাণাদি সংগ্রহ করতে দেশের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) বা তথ্য উপাত্ত দিয়ে আইনি সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠানো হচ্ছে।
পাচার করা বা অবৈধ সম্পদ শনাক্ত করে এমএলএআর পাঠানো হলে সংশ্লিষ্ট দেশ তথ্য দিয়ে আইনগত সহায়তা করে থাকে। এখন পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এমএলএআর পাঠানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে সংগ্রহ করা তথ্য-উপাত্ত দালিলিক প্রমাণ হিসাবে আদালতে উপস্থাপন করা হবে। আদালতের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অবরুদ্ধকরণ, ক্রোক ও সংযুক্তকরণ করা হচ্ছে।
যেসব ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে সেগুলো জব্দ করা হচ্ছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে অবৈধ সম্পদ আদালতের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় দেওয়া আদালতের আদেশ সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠানো হবে। ওই দেশে অবৈধ সম্পদের মালিক মামলা করলে তা মোকাবিলা করে রায় সরকারের পক্ষে আনার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর মামলা না হলে সম্পদ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে।
বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের অফিস অন ড্রাগ অ্যান্ড ক্রাইমের (ইউএনওডিসি) একটি যৌথ উদ্যোগ হচ্ছে ‘দ্য স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি (এসটিএআর)’। যেসব দেশ থেকে সম্পদ পাচার হয়েছে ওইসব দেশকে এই সংস্থাটি পাচার করা সম্পদ উদ্ধারের পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়তা করে।
সংস্থাটি পাচার করা সম্পদ উদ্ধারেও দেশগুলোর সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করে থাকে। ২০০৭ সালে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩৫টি দেশকে পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে সহায়তা করেছে। ২০২৩ সালে মোট ২০টি দেশ তাদের সহায়তা নিয়েছে। এর মধ্যে তিনটি দেশ পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে সহায়তা এবং ৬টি দেশ সহায়তা নিয়ে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি প্রতিরোধে সক্ষমতা জোরদার করেছে। ১২টি দেশ সহায়তা নিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছেছে।
সংস্থাটির মতে, দেশের ভেতরে দুর্নীতি প্রতিরোধের কাঠামো শক্তিশালী করা গেলে সম্পদ পাচার এমনিতেই কমে যাবে। এজন্য পাচার করা সম্পদ উদ্ধারের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি প্রতিরোধে সংস্থাটি সহায়তা করবে। সারা বিশ্বেই বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের শাখা অফিস রয়েছে। ফলে ওইসব দেশ থেকেই সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির নামে সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করা তাদের পক্ষে সহজ।
সুইজারল্যান্ড ও জার্মানির উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ইন্টারন্যাশনাল এন্টি করাপশন কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (আইএসিসিসি)। এই সংস্থার সদস্য হিসাবে রয়েছে প্রভাবশালী ছয়টি দেশের ১০টি তদন্ত সংস্থা। এগুলো হচ্ছে-অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পুলিশ, নিউজিল্যান্ডের সিরিয়াস ফ্রড অফিস, নিউজিল্যান্ড পুলিশ, রয়েল কানাডিয়ান মাউনট্যান্ট পুলিশ, সিঙ্গাপুরের দুর্নীতিবিরোধী ব্যুরো, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাবিষয়ক তদন্ত সংস্থা। এই সংস্থা পাচার করা অর্থ-সম্পদ শনাক্ত ও উদ্ধারে সহায়তা করলে সংশ্লিষ্ট ছয়টি দেশে পাচার করা সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এছাড়াও তাদের প্রভাবের কারণে অন্যান্য দেশে পাচার করা সম্পদের তথ্যও তদন্ত করে শনাক্ত করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস একটি প্রভাবশালী সংস্থা। যেসব দেশে তাদের দূতাবাস রয়েছে ওইসব বেশির ভাগ দেশেই এ সংস্থার শাখা অফিস রয়েছে। তারাও অবৈধ সম্পদ শনাক্ত ও সেগুলো উদ্ধারে সহায়তা করতে পারে। এ সংস্থা ফিলিপাইনসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশকে পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে সহায়তা করেছে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাসেট রিকোভারি (আইসিএআর)। সংস্থাটি সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করা সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করতে পারে।
সূত্র জানায়, পাচারকৃত অর্থ এসব সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করলে সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। যেটি বাংলাদেশও আলোচ্য ১১ ব্যক্তি ও শিল্প গ্রুপের সম্পদ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এগুলো এখন উদ্ধারে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায়ও ওইসব সংস্থাগুলো সহায়তা করবে। এর বাইরে সরকার আরও কিছু এজেন্ট নিয়োগ করবে, যারা শনাক্ত করা অর্থ উদ্ধারে আইনি প্রক্রিয়ায় সরকারকে সহায়তা করবে। তাদের নগদ কোনো অর্থ দেওয়া হবে না। উদ্ধার করা অর্থ থেকে একটি কমিশন দেওয়া হবে। এ বিষয়ে এখন সংশ্লিষ্ট এজেন্টগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ১১ ব্যক্তি ও শিল্প গ্রুপ ছাড়াও আরও অনেকে টাকা পাচার করেছে বলে অভ্যন্তরীণ তদন্তে তথ্য পাওয়া গেছে। এ কারণে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ১১টি ঘটনা ছাড়াও অন্যান্য অর্থ পাচারের ঘটনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সিআইডির মাধ্যমে তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ২০০ কোটি টাকা বা এর বেশি পরিমাণ বিদেশে পাচার করা অর্থের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক আইনি ফার্ম কোম্পানি নিয়োগ দেওয়া হবে।
এদেরকে এ মর্মে চুক্তি করা হবে যে, অর্থ উদ্ধারের বিপরীতে দালিলিক প্রমাণপত্র ও সম্পদের অবস্থানের তথ্য দেওয়া হবে। বাংলাদেশের আদালতের রায়ের কপিও দেওয়া হবে। এগুলো দিয়ে তারা সংশ্লিষ্ট দেশে আইনি লড়াই করবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করবে।
এসব খাতে বাংলাদেশ কোনো খরচ দেবে না। উদ্ধার করা অর্থ থেকে তাদের বিশেষ কমিশন বা একটি অংশ থোক হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হবে। যা লিটিগেশন ফান্ড নামে পরিচিত। এই ফান্ডের মাধ্যমেই পাচার করা অর্থ উদ্ধারের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য বিএফআইইউ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে সংগ্রহ করছে। এ বিষয়ে কয়েকটি ফার্ম বা কোম্পানি ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে।
বিশ্বব্যাপী মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করছে এগমন্ট গ্রুপ। বাংলাদেশ এর সদস্য। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, কানাডাসহ ১৭০টি দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট এর সদস্য। বাংলাদেশের বিএফআইইউ সদস্য হিসাবে এগমন্ট গ্রুপের সঙ্গে কাজ করছে। সংস্থাটির আইন অনুযায়ী এই গ্রুপের মাধ্যমে বিএফআইইউ পাচার করা সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এ কারণে বিএফআইইউ নিজস্ব উদ্যোগে এগমন্ট গ্রুপের মাধ্যমে পাচার করা সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করছে।
বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে আলোচ্য ১১টি ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৫টি দেশে পাচার করা সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। দেশগুলো হচ্ছে-যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, কেম্যান দীপপুঞ্জ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সাইপ্রাস, কানাডা, আইল অব ম্যান, থাইল্যান্ড, জার্সি, আলবেনিয়া, ডমিনিকা ও সুইজারল্যান্ডে। এসব দেশে পাচার করা অর্থ সম্পদ উদ্ধারের জন্য এখন জোরালোভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় পথে হাঁটছে সরকার।
সূত্র: যুগান্তর