কুমিল্লা নগরে কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর বেপরোয়া হয়ে ফিরেছে ‘কিশোর গ্যাং’। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার বিকেলে কুমিল্লা নগরে দেশীয় অস্ত্র হাতে মহড়া দেয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এতে নগরবাসীর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
গতকাল বেলা তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত নগরের কান্দিরপাড় এলাকার রানীর দিঘির পাড়, তালপুকুরপাড় ও আদালতপাড়া এলাকায় তিনটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মহড়া দেয়। জানা গেছে, নিজেদের অবস্থান জানান দিতে তারা এভাবে মহড়া দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নগরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৫ সালের দিকে কুমিল্লা নগরে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। নগরে ‘রতন’, ‘ঈগল’, ‘র্যাক্স’, ‘এক্স’, ‘এলআরএন’, ‘সিবিক’, ‘মডার্ন’, ‘রকস্টার’, ‘ডিস্কো বয়েজ’, ‘বস’সহ কমপক্ষে ২০টি কিশোর গ্যাং আছে। এসব গ্যাং নিজেদের আধিপত্য দেখাতে প্রকাশ্যে সহিংসতায় জড়াচ্ছে। ২০১৭ সালের পর কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ৮ বছরে অন্তত ১২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া মাদক কারবার, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ইভটিজিংয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে এসব গ্যাং।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২২ এপ্রিল সকালে নগরের ধর্মসাগর পাড়ের রানীর কুঠি এলাকায় নাফিজ অময় (২৫) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে কিশোর গ্যাং রতন গ্রুপের সদস্যরা।
এ ঘটনায় নাফিজ অময় কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় নগরের ছোটরা মফিজাবাদ কলোনির রতন, তাঁর প্রধান সহযোগী সাইফুলসহ তিনজনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৫০ জনকে আসামি করা হয়। আসামিরা সবাই রতন গ্রুপের সদস্য। ঘটনার পর রতন গ্রুপের সদস্যরা গা ঢাকা দেওয়ায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
নাফিজের এক বন্ধু নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, রতন গ্রুপ নগরের কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং তাদের গ্রুপে সদস্যও বেশি। বিগত সময়ে অন্য গ্রুপগুলো রতন গ্রুপের কারণে সক্রিয় হতে পারেনি। নাফিজ অময়ের মামলায় বর্তমানে রতন ও সাইফুল পলাতক থাকার সুযোগে শুক্রবার নগরের তিন এলাকায় তিনটি গ্রুপ মহড়া দিয়েছে।
নগরের অন্তত ৫টি কিশোর গ্যাং গ্রুপের সঙ্গে জানাশোনা আছে এমন একজন ব্যক্তি (তিনি আগে একটি কিশোর গ্যাংয়ের নেতা পর্যায়ের ছিলেন, বর্তমানে সরে এসেছেন) নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। তিনি বলেন, রতন গ্রুপের মূল নাম হলো ‘র স্কোয়াড’। শুক্রবার যারা তিন এলাকায় মহড়া দিয়েছে, এদের মধ্যে একটি গ্রুপ হলো ‘সিবিকে’; আরেকটি হলো ‘ঈগল গ্রুপ’। তৃতীয় গ্রুপটির তেমন কোনো নাম নেই। রতন গ্রুপ বর্তমানে চাপে থাকায় বাকি গ্রুপগুলো নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে।
কিশোর গ্যাংগুলোকে কারা পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি আরও বলেন, কোনো না কোনো পাওয়ার পার্টির লোক পেছন থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও তাঁদের নাম কখনো সামনে আসে না। আগে আওয়ামী লীগের লোকজন এদের নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এখন বিএনপির কোনো কোনো নেতা এদের পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুমিল্লা নগরে কিশোর গ্যাংয়ের নামে বর্তমানে যে সন্ত্রাস দেখা যাচ্ছে, এগুলো আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণে বিএনপির কেউ জড়িত রয়েছেন বলে আমার কাছে তথ্য নেই। তবে যদি এমন কোনো তথ্য–প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই দলীয় ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৩ জানুয়ারি বিকেলে নগরের ভিক্টোরিয়া কলেজ-সংলগ্ন রানীর দিঘির পাড়ে অস্ত্রের মহড়া দেয় কিশোর গ্যাংয়ের অর্ধশতাধিক সদস্য। এ সময় ককটেলের বিস্ফোরণও ঘটানো হয়। ওই ঘটনার পর কিশোর গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তৎপর হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ৯ জানুয়ারি ভোরে নগরের টাউন হল মাঠে দেশি অস্ত্রসহ কিশোর গ্যাংয়ের সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৪ জানুয়ারি নগরের ঝাউতলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের একজনকে গ্রেপ্তার করে জেলা ডিবি পুলিশ। এরপর ২৫ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা থেকে ২৬ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত কুমিল্লা নগরের বিভিন্ন এলাকায় যৌথ অভিযানে কিশোর গ্যাংয়ের ৪ সদস্যসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মহিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, শুক্রবার যারা নগরের বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে, তাদের বেশির ভাগই পথশিশু, কিশোর ও তরুণ। যখনই নগরের কিশোর গ্যাং মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় সেটি বন্ধ হয়েছে। শুক্রবারের ঘটনার পর থেকে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছি। সিসিটিভি ফুটেজ এবং বিভিন্ন মাধ্যমে বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসী তৎপরতা নির্মূলে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি।’
গতকালের সশস্ত্র মহড়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি অধ্যাপক লিখিল চন্দ্র রায়। আজ প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা ভেবেছিলাম, একটি স্বস্তিদায়ক সময় পার করব; কিন্তু সময়টা পার করতে হচ্ছে উদ্বেগের মধ্য দিয়ে। গতকালের ঘটনাটি আমি ফেসবুকে দেখে খুবই উদ্বিগ্ন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করা উচিত এবং যাঁরাই এসব কিশোর গ্যাংকে পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁদের সামনে আনা উচিত। পাশাপাশি কিশোর ও তরুণের প্রতি অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।
সূত্র: প্রথম আলো