ভারত ও পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের উত্তেজনা শেষবার যখন সংঘর্ষে রূপ নিয়েছিল, তখন ভারতীয় কর্মকর্তারা এক অস্বস্তিকর বাস্তবতার সম্মুখীন হতে বাধ্য হন। ওই সময় দেশটির বিশাল সামরিক বাহিনীকে অনেকটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছিল; তারা ছিল সেকেলে এবং সীমান্তে হুমকি মোকাবিলায় অপ্রস্তুত।
পাকিস্তানের হাতে ২০১৯ সালে একটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনায় লজ্জায় পড়ে যায় দেশটি। এতে ভারতের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সামরিক বাহিনীতে কয়েক শ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেন। অস্ত্র কিনতে নতুন আন্তর্জাতিক মিত্র খুঁজে নেন। দেশীয়ভাবে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন বাড়ান। এসব প্রচেষ্টায় ঠিক কতটুকু পরিবর্তন এসেছে, হয়তো খুব শিগগিরই তার পরীক্ষা হবে।
ভারত ও পাকিস্তান আবারও একটি সামরিক সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। কারণ, কাশ্মীরে প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে ভারত। দেশটি বলছে, এর সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পৃক্ততা আছে। উত্তেজনা দ্রুতই এতটা বেড়ে গেছে যে, পাকিস্তানের প্রবাহিত কয়েকটি নদীর পানিপ্রবাহ আটকে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে ভারত। এমন কঠোর পদক্ষেপ কয়েক দশকে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের সময়েও নেওয়া হয়নি।
কাশ্মীরের মনোরম এক উপত্যকায় ২২ এপ্রিল দুই ডজনেরও বেশি পর্যটককে হত্যার ঘটনা ভারতীয়দের স্তম্ভিত করেছে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর পাকিস্তানে হামলা চালাতে ব্যাপক অভ্যন্তরীণ চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষকেরা দীর্ঘমেয়াদি ও বিপজ্জনক অচলাবস্থার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। কারণ, পারমাণবিক শক্তিধর এ দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ বেশ কয়েক বছর আগেই অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। আর বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বর্তমানে অন্যান্য সংকট নিয়ে ব্যতিব্যস্ত আছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতের সামরিক বাহিনী এখনো আধুনিকায়নের পর্যায়ে রয়েছে। এ অবস্থায় দুর্বলতা ফাঁস হওয়ার ভয়ে জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে সংযমী হতে পারে ভারত।
২০১৮ সালে এক সংসদীয় প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভারতের ৬৮ শতাংশ সামরিক সরঞ্জাম ‘সেকেলে’, ২৪ শতাংশ এখনকার মানের এবং মাত্র ৮ শতাংশ ‘সর্বাধুনিক’। পাঁচ বছর পর ২০২৩ সালে দেওয়া এক হালনাগাদ প্রতিবেদনে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, বিশাল আকারের বাহিনী হওয়ার চ্যালেঞ্জের কারণে পর্যাপ্ত পরিবর্তন আসেনি।
যদিও ২০২৩ সালের সংসদীয় শুনানিতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সর্বাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, তবু একটি আধুনিক সেনাবাহিনীর মানের বিবেচনায় এটি অনেক কম। অর্ধেকেরও বেশি সরঞ্জাম এখনো পুরোনোই রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব সীমাবদ্ধতার কারণে নরেন্দ্র মোদি তুলনামূলক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক হামলার পথ বেছে নিতে পারেন। যেমন, সীমিত পরিসরে বিমান হামলা বা পাকিস্তান সীমান্তের কাছে বিশেষ বাহিনীর অভিযান। এসব অভিযান জনরোষ প্রশমিত করবে, সম্ভাব্য বিব্রতকর ভুলের ঝুঁকি কমাবে এবং প্রতিশোধমূলক হামলা এড়াতে কাজে আসবে। এদিকে পাকিস্তান সরকার ইতিমধ্যে সতর্ক করেছে, ভারত হামলা করলে তারাও একই ধরনের জবাব দেবে।
পাকিস্তানে হামলা চালাতে জনমত নরেন্দ্র মোদির জন্য সহায়ক হলেও, ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো একই সঙ্গে তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়।
পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে পর্দার আড়াল থেকে সেনাবাহিনী দেশ পরিচালনা করে আসছে। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে দেশটির নেতৃত্ব তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা পাবে। তারা সংঘাত বাড়তে দিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে আরও সুবিধা নিতে পারে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে খুব সহজেই প্রতিহত করতে পারবে বলে ভারত আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এ দাবির যদি পরীক্ষা নেওয়া হয়, তাহলে ভারতের আরেক প্রতিবেশী চীন তাতে নিবিড় নজর রাখবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্তে পাকিস্তানের চেয়ে চীনকে বড় সংকট হিসেবে বিবেচনা করছে ভারত। বিশেষ করে ২০২০ সালে হিমালয়ের উঁচু এলাকায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনাদের বারবার অনুপ্রবেশের পর থেকে এ অবস্থা তৈরি হয়। ফলে দেশটির সামরিক নেতৃত্বকে দুই ফ্রন্টে লড়তে হবে এমন এক যুদ্ধের সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়েই প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। এ ধরনের বহুমুখী চাপ তাদের সামর্থ্যকে ভাগ করে ফেলে।
ভারত স্থানীয়ভাবে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনেও ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, প্রতিরক্ষা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এখন কিছুটা ধীরগতিতে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে সামরিক বাহিনীকে এটি আরও ভালো অবস্থানে নিয়ে যাবে।
যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়া থেকে শিক্ষা নেয় ভারত
২০২০ সালে চীনের সঙ্গে সংঘাতের এক বছরের একটু বেশি সময় আগে পাকিস্তান ভারতীয় একটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করে এবং এর পাইলটকে আটক করে। নয়াদিল্লিভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার স্টাডিজের’ নেতৃত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় জেনারেল দুষ্যন্ত সিং বলেন, বিমান ভূপাতিতের ঘটনা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর জন্য সজাগ হওয়ার বার্তা হিসেবে আসে।
দুষ্যন্ত সিং বলেন, এরপর থেকে ভারত নিজেদের সামরিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য ‘বিভিন্ন পথ’ অনুসন্ধান করেছে। দেশটি আমেরিকার আপত্তির পরেও রাশিয়ার কাছ থেকে সংগ্রহ করা নতুন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে। পাশাপাশি ফ্রান্স থেকে কয়েকজন ডজন যুদ্ধবিমান এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করেছে।
বৈশ্বিকভাবে যখন সরবরাহ ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা বাড়ছে, তখন ভারত স্থানীয়ভাবে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনেও ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, প্রতিরক্ষা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এখন কিছুটা ধীরগতিতে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে সামরিক বাহিনীকে এটি আরও ভালো অবস্থানে নিয়ে যাবে।
দুষ্যন্ত সিং বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতা এমন হওয়া দরকার যেন তা বিদ্যমান সামর্থ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে যেতে পারে।’ আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘রাতারাতি এ উদ্যোগগুলোর ফল আসবে না। এতে কিছুটা সময় লাগবে।’
বিশ্লেষকেরা বলেছেন, ভারতের সামরিক বাহিনীকে আধুনিকীকরণে চ্যালেঞ্জগুলো বহুমুখী— প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক এমনকি ভূরাজনৈতিকও।
প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া সহজ করার পাশাপাশি বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। তবে বাহিনীগুলোর মধ্যে কর্তৃত্বের লড়াই থাকায় এ কাজ কঠিন বলেই প্রমাণিত হয়েছে। মোদি সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের দায়িত্ব দিয়েছিলেন শীর্ষ পর্যায়ের এক জেনারেলকে, যিনি ২০২১ সালে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হলে এ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
ভারতের অর্থনীতি এখন বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম অবস্থানে আছে, পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় দশগুণ বড়। ফলে ভারত সামরিক খাতে বরাদ্দের জন্য এখন আরও বেশি সম্পদ ব্যয় করতে পারছে। কিন্তু দেশটির বিপুল জনসংখ্যা ব্যাপক চাহিদা পূরণে সরকারকে নজর দিতে হচ্ছে বলে ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় এখনো মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) ২ শতাংশেরও কম। বিশেষজ্ঞদের মতে এটা অপর্যাপ্ত।
২০২০ সালে সংঘর্ষের পরে চীন সীমান্তে চার বছর ধরে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন রাখার ব্যয়বহুল উদ্যোগ ভারতের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের প্রক্রিয়াকে পিছিয়ে দেয়। আরেকটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। এটি ভারতের সবচেয়ে বড় উৎস রাশিয়া থেকে অস্ত্র সরবরাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সংসদে দেওয়া দাপ্তরিক নথিতে দেখা গেছে, অর্থ বরাদ্দ থাকলেও সামরিক বাহিনী তা ব্যয় করতে হিমশিম খাচ্ছে। কারণ ‘বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির’ কারণে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় ক্রয়াদেশ অনুযায়ী সামরিক সরঞ্জাম পাওয়া যাচ্ছে না।
বিশ্লেষকেরা বলেছেন, এ ধরনের সীমাবদ্ধতার মুখে ভারত সবার আগে বড় ঘাটতিগুলো পূরণের চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি গোপন অভিযানের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান থেকে নিয়ন্ত্রিত ভারতবিরোধী জঙ্গিদের হত্যা করতে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযান চালিয়েছে।
অস্ত্র আমদানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় ভারত
গত পাঁচ বছর ধরে সামরিক সরঞ্জাম আমদানিতে ইউক্রেনের পরেই ভারত দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে। এদিকে পাকিস্তান ছিল বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম আমদানিকারকের স্থানে।
রাশিয়া এখনো ভারতের অস্ত্রের প্রধান সরবরাহকারী হলেও গত পাঁচ বছরে তাদের কাছ থেকে কেনা অস্ত্রের পরিমাণ প্রায় ২০ শতাংশ কমে এসেছে। অস্ত্র কিনতে ভারত ক্রমেই ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকছে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও তারা রাশিয়া থেকে কেনা পাঁচটি এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে তিনটি মোতায়েন করেছে। ফ্রান্স থেকে কেনা ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমানের সবগুলো বিমানবাহিনীতে যুক্ত করা হয়েছে। আরও ২৬টি কেনার পরিকল্পনা করছে। ভারত এখন দেশীয়ভাবে নির্মিত অনেকগুলো যুদ্ধজাহাজ নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত করছে।
নয়াদিল্লিভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা মনে করেন, ‘সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো রাফাল যুদ্ধবিমানের অন্তর্ভুক্তি। এগুলো ভারতীয় বাহিনীর সক্ষমতায় বড় উন্নতি সাধন করেছে।’
শুক্লা বলেন, মূল চ্যালেঞ্জ হলো এই নতুন সামরিক সরঞ্জাম দক্ষতার সঙ্গে মোতায়েন করা যা শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে ‘কার্যকর প্রতিরোধ’ গড়ে তুলবে।
এই প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক বলেন, ‘আমি নিশ্চিত হতে চাই যে আমরা যেন আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে না থাকি। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সামরিক সরঞ্জাম থাকলেও, চূড়ান্ত মুহূর্তে যখন সেগুলোর ব্যবহার প্রয়োজন হবে, তখন (দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে না পারায়) দেখা গেল প্রকৃতপক্ষে সেগুলো আমাদের নেই।
সূত্র: প্রথম আলো