উন্নত গবেষণাসুবিধা, প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় এবং নিরাপদ ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ পরিবেশ—এসবের সমন্বয়ে জাপান এখন বিশ্বের উচ্চশিক্ষার্থীদের কাছে একটি কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। প্রতিবছর বিশ্বের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মতো বাংলাদেশ থেকেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী জাপানে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে পা বাড়াচ্ছেন। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপান, যেখানে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনভিত্তিক বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র রয়েছে, যা পড়াশোনার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করে।
জাপানে কেন পড়তে যাবেন?
জাপানের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়—মেক্সট (Ministry of Education, Culture, Sports, Science and Technology–এর সংক্ষিপ্ত রূপ ‘মেক্সট’–MEXT)–এর অধীন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বহু আগেই স্থান করে নিয়েছে কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ তালিকায়। উদাহরণস্বরূপ—
-ইউনিভার্সিটি অব টোকিও—২৮তম
-কিয়োটো ইউনিভার্সিটি—৪৬তম
-ওসাকা ইউনিভার্সিটি—৮০তম
-টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি—৯১তম
বিশ্ববিদ্যালয় ও কোর্স নির্বাচনের কৌশল
জাপানে বর্তমানে ৭০০-এর বেশি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে—
-৮৭টি ন্যাশনাল
-৯৭টি পাবলিক
-৬০০+ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করার সময় যেসব বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে—
-বিশ্ব র্যাঙ্কিং ও স্বীকৃতি
-গবেষণার সুযোগ
-শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত
-কোর্সের বিষয়বস্তু
-স্কলারশিপ–সুবিধা
শীর্ষ জাপানি বিশ্ববিদ্যালয় হলো: ইউনিভার্সিটি অব টোকিও, কিয়োটো ইউনিভার্সিটি, ওসাকা ইউনিভার্সিটি, টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, তোহোকু ইউনিভার্সিটি, কিউশু ইউনিভার্সিটি, নাগোয়া ইউনিভার্সিটি, হোক্কাইডো ইউনিভার্সিটি, ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটি ও কুমামোতো ইউনিভার্সিটি।
জনপ্রিয় বিষয়গুলো—
প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা সায়েন্স, কম্পিউটারবিজ্ঞান, ব্যবসা প্রশাসন, অর্থনীতি, হেলথকেয়ার ও পরিবেশবিজ্ঞান।
আবেদনপদ্ধতি ও সময়সীমা
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভর্তিপ্রক্রিয়া ও সময়সূচি রয়েছে। তাই নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট অনুসরণ করাই সবচেয়ে ভালো উপায়।
জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সেপ্টেম্বর সেশনের জন্য আবেদন করতে হয় মে–জুন মাসে। আর এপ্রিল সেশনের জন্য আবেদন নভেম্বর-ডিসেম্বরে। (বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে সময়সীমায় ভিন্নতা থাকতে পারে।)
*আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস
১. একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট ও সনদ
২. স্টেটমেন্ট অব পারপাস (SOP)
৩. গবেষণা প্রস্তাবনা (বিশেষত মাস্টার্স/ পিএইচডি পর্যায়ে)
৪. রেফারেন্স লেটার (২টি)
৫. ইংরেজি দক্ষতার প্রমাণ (টোয়েফল বা আইএলটিএস (TOEFL/ IELTS) অথবা মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি শিক্ষার প্রমাণপত্র)
৬. পাসপোর্ট, ছবিসহ অন্যান্য আবেদন ফর্ম
*SOP: নিজের গল্প বলার জায়গা
স্টেটমেন্ট অব পারপাস হলো আবেদনকারীর নিজের শিক্ষাজীবন, আগ্রহ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরার সৃজনশীল সুযোগ। সংগঠিত, সংক্ষিপ্ত ও বিশ্বাসযোগ্য ভাষায় SOP লেখা অধিক গ্রহণযোগ্য। সফল SOP লিখতে এগুলো অনুসরণ করতে পারেন—
-নিজের শিক্ষাগত ও পেশাগত পটভূমি উল্লেখ
-কেন জাপান বেছে নিয়েছেন
-পছন্দের বিষয়ের সঙ্গে ভবিষ্যতের যোগসূত্র
-গবেষণায় আগ্রহ ও লক্ষ্য স্পষ্টভাবে উপস্থাপন
*টোয়েফল বা আইইএলটিস কি আবশ্যক?
-অনেক কোর্স ইংরেজি মাধ্যমে হলেও টোয়েফল বা আইইএলটিস স্কোর চাওয়া হয়
-“Medium of Instruction” সনদ থাকলেও, স্কোর থাকলে তা বাড়তি সুবিধা দেয়
-মেক্সট বৃত্তিতে ভাষা স্কোর বাধ্যতামূলক নয়**, তবে মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষায় ইংরেজি দক্ষতার প্রমাণ দিতে হয়
-জাপানি ভাষা জানা থাকলে সেটি বাড়তি প্লাস পয়েন্ট হিসেবে ধরা হয়।
*বৃত্তির সুযোগ: স্বপ্নের পথে সহযাত্রী
মেক্সট (MEXT) বৃত্তি: জাপান সরকারের মনবুকাগাকুশু (Monbukagakusho) মেক্সট বৃত্তি বিশ্বের অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক সরকারি বৃত্তি, যার আওতায় স্নাতক, মাস্টার্স, পিএইচডি ও প্রশিক্ষণ কোর্সে শিক্ষার্থীরা সুযোগ পেয়ে থাকেন।
*সুবিধাসমূহ—
-সম্পূর্ণ টিউশন ফি
-মাসিক ভাতা (১১৭,০০০-১৪৫,০০০)
-বিমানভাড়া
-জাপানি ভাষা শিক্ষার সুযোগ
*আবেদনপদ্ধতি—
বাংলাদেশে জাপানি দূতাবাসের মাধ্যমে প্রতিবছর মে-জুনে আবেদন আহ্বান করা হয়। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পর প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের জাপানের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Letter of Acceptance নিতে হয়। এ ছাড়া কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইউনিভার্সিটি রিকমেন্ডেড MEXT বৃত্তি’ প্রদান করে থাকে।
জাইকা (JICA) বৃত্তি—
পেশাজীবীদের জন্য উন্নয়নভিত্তিক শিক্ষা। জাইকা মূলত সরকারি বা আধা সরকারি কর্মকর্তা ও পেশাজীবীদের জন্য উচ্চশিক্ষা এবং উন্নয়নমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান করে।
জেডিএস (JDS) বৃত্তি—
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিচার বিভাগ ও লেজিসলেটিভ বিভাগের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য এই স্কলারশিপের আওতায় পিএইচডি ও মাস্টার্স কোর্সে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ—
এই প্রশিক্ষণ তরুণ প্রশাসক, গবেষক এবং ব্যবসায়ীদের জাপানের জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চতর ডিগ্রি (এমএ, পিএইচডি ইত্যাদি) পড়ার সুযোগ করে দেয়।
সুবিধাসমূহ—
-সম্পূর্ণ টিউশন ফি
-থাকা-খাওয়ার খরচ
-আন্তর্জাতিক বিমানভাড়া
-গবেষণা খরচ
-জীবনযাপনের মাসিক ভাতা
বিশেষ দিক—
শিক্ষার্থীর চাকরির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় নির্বাচন, দেশে ফিরে কাজের প্রয়োগ এবং উন্নয়নমুখী পরিকল্পনার প্রতিফলন বিবেচনায় নেওয়া হয়।
প্রাইভেট ও বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক স্কলারশিপ—
অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন স্কলারশিপ প্রদান করে
-JASSO স্কলারশিপ—মাসিক ৪৮,০০০
-ADB-Japan Scholarship Program—মাস্টার্স পর্যায়ে
-Rotary Yoneyama, Honjo, INPEX, Mitsui Foundation, Well-Being প্রভৃতি
বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক স্কলারশিপের জন্য সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে নিয়মিত নজর রাখতে পারেন।
*কাজের সুযোগ
জাপানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য সপ্তাহে ২৮ ঘণ্টা কাজ করার অনুমতি রয়েছে, যা খরচ মেটাতে সহায়ক হতে পারে।
সঠিক পরিকল্পনায় সফল ভবিষ্যৎ
জাপানে উচ্চশিক্ষা শুধু একটি ডিগ্রির নাম নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, গবেষণার গভীরতা এবং ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচনের নাম। সঠিক সময়ের প্রস্তুতি, বৃত্তির সুযোগ গ্রহণ এবং আত্মবিশ্বাসী আবেদন আপনাকে পৌঁছে দিতে পারে আপনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।
*লেখক: আল-আমিন, অ্যাসিস্ট্যান্ট আইটি অফিসার (অধ্যয়ন ছুটিতে), বিআইজিএম ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী (জাইকা স্কলার), কুমামোটো ইউনিভার্সিটি, জাপান
সূত্র: প্রথম আলো