লিভার আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ, যা রক্ত পরিশোধন, পুষ্টি সঞ্চয়, হজমে সহায়তা এবং বিষাক্ত পদার্থ নির্গমনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। তবে কিছু ভুল খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনধারা লিভারের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এসব কারণে দেখা দিতে পারে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, হেপাটাইটিস, সিরোসিস বা লিভার ক্যানসার। লিভারকে সুস্থ রাখতে যে খাবার ও অভ্যাসগুলো থেকে বিরত থাকা উচিত, তা নিচে তুলে ধরা হলো:
১. অতিরিক্ত চিনি ও ফ্রুকটোজ সমৃদ্ধ খাবার
চিনি, বিশেষ করে উচ্চ ফ্রুকটোজ কর্ন সিরাপযুক্ত পানীয় ও প্রক্রিয়াজাত খাবার। এটি লিভারে চর্বি জমাতে সহায়তা করে। এই চর্বি জমে ফ্যাটি লিভার তৈরি হয়, যা এক পর্যায়ে প্রদাহ ও কোষ নষ্টের মাধ্যমে সিরোসিসের দিকে যেতে পারে।
২. প্রক্রিয়াজাত ও ফাস্ট ফুড
বার্গার, চিপস, প্যাকেটজাত খাবার ইত্যাদিতে থাকা ট্রান্স ফ্যাট, কৃত্রিম রং এবং সংরক্ষণকারী রাসায়নিক লিভারের কোষে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস সৃষ্টি করে। নিয়মিত এসব খাবার খেলে লিভারের টিস্যু দুর্বল হয়ে যায়।
৩. অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ
প্রচুর পরিমাণে লবণ খাওয়া (বিশেষত ইনস্ট্যান্ট নুডলস, প্রিজার্ভড মিট ইত্যাদির মাধ্যমে) লিভারে পানি জমার ঝুঁকি বাড়ায় এবং রক্তচাপ বৃদ্ধির পাশাপাশি লিভার ফাংশনেও বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
৪. ওষুধের অপব্যবহার
অ্যাসিটামিনোফেন (প্যারাসিটামল), কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড ও স্ট্যাটিন জাতীয় ওষুধ অতিরিক্ত মাত্রায় বা দীর্ঘদিন ব্যবহারে লিভার এনজাইমে সমস্যা সৃষ্টি করে। অনেক সময় এসব ক্ষতি নীরবে হয়।
৫. অ্যালকোহল
লিভারের অন্যতম প্রধান শত্রু হলো অ্যালকোহল। এটি লিভারের কোষ ভেঙে ফেলে, প্রদাহ তৈরি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে সিরোসিসের দিকে ঠেলে দেয়। এমনকি অল্প পরিমাণে নিয়মিত পান করলেও লিভারের ক্ষতি হতে পারে।
৬. ভাইরাস সংক্রমণ (হেপাটাইটিস B, C)
এই ভাইরাসগুলো লিভারে ধীরে ধীরে সংক্রমণ ঘটিয়ে কার্যকারিতা ব্যাহত করে। সচেতনতা, সুরক্ষা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এর প্রতিকার।
৭. ধূমপান ও ধোঁয়ার সংস্পর্শ
তামাকের ধোঁয়ায় থাকা রাসায়নিক পদার্থ রক্তে শোষিত হয়ে লিভারে পৌঁছে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরি করে। ধূমপান শুধু ফুসফুস নয়, লিভারের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর।
৮. পানিশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন)
পর্যাপ্ত পানি না খেলে লিভারের বিষমুক্ত করার কাজ ব্যাহত হয়। এতে করে বর্জ্য পদার্থ জমে শরীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
৯. প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব
কোলিন: ডিম, মাছ, ফুলকপি ইত্যাদিতে পাওয়া যায়, যা চর্বি ভাঙতে সাহায্য করে।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: মাছ ও বাদামে থাকে, প্রদাহ কমায়।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (যেমন ভিটামিন E): লিভারকে মুক্ত র্যাডিক্যাল থেকে সুরক্ষা দেয়।
১০. অলস জীবনধারা ও অতিরিক্ত ওজন
ব্যায়াম না করা এবং অধিক ওজন লিভারে চর্বি জমার কারণ হয়। পেটের চারপাশে মেদ জমা থাকলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়ে, যা ফ্যাটি লিভারের প্রধান কারণ।
১১. ঘুমের অভাব ও মানসিক চাপ
অপ্রতুল ঘুম লিভারের বিষ মুক্ত করার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। মানসিক চাপ হরমোন ভারসাম্য নষ্ট করে লিভারের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।
১২. দূষিত খাবার ও পরিবেশগত বিষ
শিল্প এলাকার কাছে উৎপাদিত খাবারে বা অপরিষ্কার জলে ভারী ধাতু (যেমন পারদ, সিসা) থাকার সম্ভাবনা বেশি। এসব বিষাক্ত পদার্থ লিভারে জমে কোষ নষ্ট করে।
লিভার সুস্থ রাখতে যা করবেন:
-পরিমিত চিনি ও চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন
-পর্যাপ্ত পানি পান করুন
-নিয়মিত ব্যায়াম করুন
-স্বাস্থ্যকর ও প্রাকৃতিক খাবার খান
-নিয়মিত হেলথ চেক-আপ করুন
-হেপাটাইটিস বি ও সি প্রতিরোধে ভ্যাকসিন ও সচেতনতা অবলম্বন করুন
লিভার এমন একটি নীরব যোদ্ধা, যার ক্ষতির সময় অনেক সময়ই আমরা বুঝি না। তবে সচেতন জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাস পাল্টালে সহজেই লিভারকে সুস্থ রাখা সম্ভব।