বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে’ আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে, সেটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে- তা নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। খবর বিবিসি বাংলার।
বিশ্লেষকরা কেউ কেউ বলছেন, জুলাই অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের বিচার হতে হবে কিন্তু ‘যে প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধের দাবিটি সামনে এনে সরকার অগ্রসর হয়েছে’ তা ভবিষ্যতে প্রতিপক্ষ দমনে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠতে পারে।
আবার কেউ বলছেন, শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দিকে গড়ালে এবং সেই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা শুরু করলে সংঘাত সংঘর্ষের রাজনীতিই আবার ফিরে আসতে পারে। আর সংঘর্ষ, সহিংস রাজনীতি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
এদিকে গতকাল শনিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের এক বিশেষ সভায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার সরকারি আদেশ হাতে পাওয়ার পর দলটির নিবন্ধন বাতিলে করণীয় ঠিক করার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ হলে বা চূড়ান্তভাবে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলে আওয়ামী লীগের পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে না।
সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় শনিবার রাতেই লিখেছেন, বিচারিক প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত ভাবে নিষিদ্ধ হওয়াই অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও স্থায়ী বন্দোবস্ত। এবং তা করার জন্য ছাত্র-জনতার দাবি অনুযায়ী আইসিটি আইনে যাবতীয় সংশোধন করা হয়েছে।
এর আগে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাস বিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় বিবৃতি দিয়ে বলেছে, সরকারের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করেই আওয়ামী লীগ যথোচিতভাবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে যাবে। একই সঙ্গে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘জনগণ দাঁতভাঙ্গা জবাব দেবে’ বলেও ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
নানা আলোচনা প্রভাব নিয়ে
আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিলো ১৯৪৯ সালে এবং এর পর থেকে এ ভূখণ্ডে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবেই গত প্রায় সাত দশকেরও বেশী সময় ধরে সক্রিয় ছিলো দলটি। এ দলটির নেতৃত্বেই স্বাধীনতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু টানা ১৫ বছরেরও বেশী সময় ক্ষমতায় থাকার পর গত বছর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনাসহ দলের বেশীরভাগ নেতাই ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। দেশের মধ্যে আটক হয়ে কারাগারে আছেন সিনিয়র নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও এমপি ছাড়া দলটির কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়েরও বহু নেতা।
ওই আন্দোলনের পর থেকেই আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলো বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের একটি অংশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিটি সামনে নিয়ে আসছিল।
তবে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি আগে এ ধরনের নিষিদ্ধের দাবিকে সরাসরি সমর্থন না করে এ বিষয়ে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও জনগণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে উল্লেখ করেছিল। সরকারের সিদ্ধান্তের পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য বলেছেন, বিলম্ব হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে তারা আনন্দিত।
সবশেষ গত সপ্তাহে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ব্যাংকক যাওয়ার পর থেকেই নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির প্রভাবশালী নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসেন এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে অবস্থানের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
পরে এতে জামায়াতে ইসলামীসহ প্রথাগতভাবেই আওয়ামী লীগ বিরোধী হিসেবে পরিচিত প্রায় সব দলই তাতে সংহতি জানায়। এক পর্যায়ে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগ এলাকায় অবস্থানের কর্মসূচিও দেওয়া হয়। এর মধ্যেই শনিবার রাতে উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠক করে ‘আওয়ামী লীগ ও এর নেতাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনায় মুখর ছিলেন নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
আওয়ামী লীগের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রভাব কেমন হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য কতটা ভুল স্বীকার করে এবং কিভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসে, তার ওপরই নির্ভর করবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ।
আনু মুহাম্মদ বলছেন, জুলাই আগস্টে হত্যাকাণ্ডের বিচার জরুরি। যদিও বিচার কতটা স্বচ্ছ হচ্ছে- তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে পাইকারি মামলার কারণে। আর দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেই রাজনীতিটা চলে যায় না। দল নিষিদ্ধ করলে কী হয়, তার দৃষ্টান্ত তো জামায়াত। আওয়ামী লীগের শেষ দিকে কাগজে কলমে নিষিদ্ধের আগেও কিন্তু জামায়াত কার্যত নিষিদ্ধই ছিল। কিন্তু তাদের রাজনীতি বন্ধ হয়নি। তারা তাদের শক্তি কাজে লাগিয়েছে এবং সেটা এখন প্রকাশ্যেই দেখা যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দল হিসেবে সংকটে পড়া এবং সেখান থেকে উৎরে আসার অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগের আছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তান সরকার দলটিকে নিষিদ্ধ করলেও বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনে সফল হয়েছিল দলটি । কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বড় ধাক্কা খেলেও দলের নেতারা শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন সামরিক শাসনামলেই।
এর আগে ১৯৫৭ সালেই ভাঙনের মুখে পড়েছিলো আওয়ামী লীগ। এছাড়া পঁচাত্তরের পরেও বিভিন্ন সময়ে ভাঙন কিংবা প্রভাবশালী অনেক নেতা দল থেকে বেরিয়ে গেলেও এবারের মতো বিপর্যয়ে কখনো পড়তে হয়নি দলটিকে।
অনেকেই মনে করেন এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। কারণ সরকারে থাকা অবস্থায় জুলাই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের দায় ছাড়াও ক্ষমতা হারানোর পর দলীয় প্রধানসহ অনেক নেতাদের দেশত্যাগ দলটিকে বড় সংকটে ফেলেছে।
এমন পটভূমিতে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের পর তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিভাবে ফিরে আসার চেষ্টা করে, তার ওপর দেশ ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করবে বলে মনে করেন সংসদ বিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক নিজাম উদ্দিন আহমেদ।
তার মতে, সমাজের সব শ্রেণী পেশার মধ্যে আওয়ামী লীগের অবস্থান আছে এবং দলটি একটা সময় ফেরত আসার চেষ্টা করবে বলেই মনে করেন তিনি।
তিনি বলছেন, তাছাড়া নির্বাচন নিয়েও শঙ্কা আছে। আর যাদের আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তাদের জনসমর্থন নিয়ে প্রশ্ন আছে। সুনির্দিষ্ট অপরাধের জন্য স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়ায় বিচার হতে পারে। কিন্তু নিষিদ্ধ করা হলে তার প্রতিক্রিয়ায় এক সময় পুরো রাজনীতি সংঘাত সহিংসতাময় হয়ে ওঠার আশংকা আছে।
আবার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে যেভাবে মব তৈরি করে দাবি তোলার সুযোগ দিয়ে পরে তাদের দাবি পূরণ করা হচ্ছে, সেটিও দীর্ঘমেয়াদে প্রতিপক্ষ দমনের সহজ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে বলে মনে করছেন নিজাম উদ্দিন আহমেদ।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদও বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের তো সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার সেটি করেনি। আমার মনে হয় সিদ্ধান্তটিই সুনির্দিষ্ট হয়নি। আওয়ামী লীগের ভেতরেও অনেকে হত্যা, দুর্নীতি, লুটপাট সমর্থন করেননি।
সহিংসতাই রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠতে পারে
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে দলটি নিষিদ্ধ হয়ে গেলে সমাজের ভেতরে থাকা সমর্থকদের কারণেই দীর্ঘমেয়াদে হলেও দলটি যখন ফিরে আসবে, তখনই সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠতে পারে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ।
তিনি বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই হলো দুই ধারায়- মোটাদাগে যার একটির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আর অপরটির নেতৃত্বে বিএনপি। দল হিসেবে ৩৫-৪০ শতাংশ ভোট আওয়ামী লীগের। এখন তারা তাদের ভুল স্বীকার করে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে এগিয়ে আসার চেষ্টা যখন করবে, তখন রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়বে।
তার মতে, নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগকে ঠেলে দিতে চাইলে রাজনীতি আরও অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত হয়ে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার শঙ্কা আছে। ফলে সহিংসতাই তখন রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ শক্তির জোরে টিকে থাকাটাই বড় হয়ে উঠতে পারে। আবার এমন পরিস্থিতির সুযোগে বিদেশীরাও আরও প্রভাবক হতে পারে, যা আরও বড় সংকট তৈরি করবে।