(গত দিনের পর) আল্লাহ তা’আলা মানুষকে জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি দিয়েই ছেড়ে দেননি। বরং এগুলোর পাশাপাশি তাকে পথও দেখিয়েছেন যাতে সে জানতে পারে শোকরিয়ার পথ কোনটি এবং কুফরীর পথ কোনটি। এরপর যে পথই সে অবলস্বন করুক না কেন তার জন্য সে নিজেই দায়ী। এ বিষয়টি সুরা বালাতে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ‘আমি কি তাকে দু’টি সুস্পষ্ট পথ দেখাইনি?’ (আয়াত : ১০)। সুরা আশ শামসে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে ‘শপথ প্রবৃত্তির আর সে সত্তার যিনি তাকে আভ্যন্তরিন শক্তি দিয়ে শক্তিশালী করেছেন। আর পাপাচার ও তাকওয়ার অনুভূতি দু’টোই তার ওপর ইলহাম করেছেন।’ (আয়াত : ৮)।
এ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সামনে রাখলে বুঝা যায় মানুষের হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তা’আলা যেসব ব্যবস্থার কথা কুরআন মাজিদে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন তাও সামনে রাখলে বুঝা যায় যে, এ আয়াতে পথ দেখানো যে কথা বলা হয়েছে তার দ্বারা পথ প্রদর্শনের কোন একটি মাত্র পন্তা ও উপায় বুঝানো হয়নি।বরং এর দ্বারা অনেক পন্থা ও উপায়ের কথা বলা হয়েছে যার কোন সীমা পরিসীমা নেই। য়েমন:
এক, প্রত্যেক মানুষকে জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধিও যোগ্যতা দেয়ার সাথে সাথে একটি নৈতিক বোধ ও অনুভূতি দেয়া হয়েছে যার সাহায্যে সে প্রকৃতিগতভাবেই ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করে, কিছু কাজ-কর্ম ও বৈশিষ্ট্যকে খারাপ বলে জানে যদিও সে নিজেই তাতে লিপ্ত। আবার কিছু কাজ-কর্ম ও গুণাবলীকে ভাল বলে মনে করে যদিও সে নিজে তা থেকে দূরে অবস্থান করে। অর্থাৎ ভালো-মন্দের জ্ঞান প্রাকৃতিকভাবে তার মধ্যে বিরাজমান।
দুই, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আল্লাহ তা’আলা বিবেক (তিরস্কারকারী নফস) বলে একটি জিনিস রেখে দিয়েছেন। যখন সে কোন মন্দ কাজ করতে উদ্যত হয় অথবা করতে থাকে অথবা করে ফেলেছে তখন এ বিবেকই তাকে দংশন করে। যতই হাত বুলিয়ে বা আদর-সোহাগ করে দিয়ে মানুষ এ বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে দিক, তাকে অনুভূতিহীন বানানোর যত চেষ্টাই করুক সে তাকে একদম নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম নয়। সেটি তাকে দংশন করতেই থাকবে।
তিন, মানুষের নিজের সত্তায় এবং তার চারপাশে যমীন থেকে আসমান পর্যন্ত গোটা বিশ্ব-জাহানের সর্বত্র এমন অসংখ্য নিদর্শনাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যা আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে এমনসব জিনিস এক আল্লাহ ছাড়া হতে পারে না কিংবা বহু সংখ্যক প্রভু এ বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টিকর্তা বা পরিচালক হতে পারে না। বিশ্ব চরাচরের সর্বত্র এবং মানুষের আপন সত্তার অভ্যন্তরে বিদ্যমান এ নিদর্শনাবলীই কিয়ামত ও আখিরাতের সুস্পষ্ট প্রমাণ পেশ করেছে। মানুষ যদি চোখ বন্ধ করে থাকে অথবা বুদ্ধি-বিবেক কাজে লাগিয়ে সব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা না করে অথবা তা যেসব সত্যের প্রতি ইংগিত করছে তা মেনে নিতে টালবাহানা ও গড়িমসি করে তাহলে তা তার নিজেরই অপরাধ। আল্লাহ তা’আলা নিজের পক্ষ থেকে তার সামনে সত্যের সন্ধান দাতা নিদর্শনাদি পেশ করতে আদৌ কোন অসম্পূর্ণতা রাখেননি।
চার, মানুষ নিজের জীবনে তার সমসাময়িক পৃথিবীতে এবং তার পূর্বের অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় এমন অসংখ্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং হয়ে থাকে যা প্রমাণ করে যে, একটি সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর শাসন-কর্তত্ব তার ওপর এবং সমগ্র বিশ্ব-জাহানের ওপর কর্তত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। যাঁর ইচ্ছা সবকিছুর ওপর বিজয়ী এবং যাঁর সাহায্যের সে মুখাপেক্ষী।
পাঁচ, মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও প্রকৃতিগত জ্ঞানের অকাট্য ও চুড়ান্ত রায় হলো, অপরাধের শাস্তি এবং উত্তম কার্যাবলীর প্রতিদান অবশ্যই পাওয়া উচিত। এ উদ্দেশ্যে দুনিয়ার প্রত্যেক সমাজে কোন না কোন রূপে বিচার-ব্যবস্থা কায়েম করা হয় এবং যেসব কাজ-কর্ম প্রশংসনীয় বলে মনে করা হয় তার জন্য পুরস্কার ও প্রতিদান দেয়ারও কোন না কোন ব্যবস্থা গ্রহণকরা হয়। যদি এ কথা স্বীকার করা হয় যে, পৃথিবীতে এমন অসংখ্য অপরাধ রয়েছে যার যথাযথ শাস্তি হয় না বা শাস্তি দেয়া সম্ভব হয় না। আবার এমন অনেক সেবামূলক বা কল্যাণমূলক কাজ আছে যার পুরস্কার সে দুনিয়াতে পায় না। তখন আখিরাত মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। কারণ উল্লেখিত অপরাধ ও ভালো কাজের পুরস্কারের জন্য আখিরাতে যেতে হবে।
ছয়, এসব উপায়-উপকরণের সাহায্যে মানুষকে হিদায়াত ও পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীতে নবী পাঠিয়েছেন এবং কিতাব নাযিল করেছেন। এসব কিতাব পরিস্কার ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে শোকরের পথ কোনটি এবং কুফরের পথ কোনটি এবং এ দু’টি পথে চলার পরিণামই বা কি। নবী রাসুল এবং তাঁদের আনীত কিতাবসমূহের শিক্ষা জানা-অজানা, দৃশ-অদৃশ্য অসংখ্য উপায় ও পন্থায় সারা পৃথিবীর প্রতিটি জনপদে পৌঁছে গেছে। সুতরাং এখন কেউ পৃথিবীর এই পরীক্ষগৃহে তার পরীক্ষা খাতায় যা মনে চায় তাই লিখতে পারে না। যদি এমনটি কেউ করে তবে সে আখিরাতে অকৃতকার্য বা বিফল হবে। আর যারা আল্লাহ নির্দেশিত ও রাসুল সা: কর্তৃক প্রদর্শিত পথে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় সে অবশ্যই কৃতকার্য ও সফল হবে।