বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, মানবিক করিডর দেওয়ার ব্যাপারে সরকার যে ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে, তাতে দেশের ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির’ মুখে পড়বে। তিনি বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের কাছ থেকে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদের কাছ থেকে। এটি অন্তবর্তী সরকারের কাজ নয়।
আজ সোমবার (১৯ মে) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে মিয়ানমারকে মানবিক করিডর দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গণশক্তি সভা আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি এসব বলেন।
ড. শাহরিয়ার ইফতেখার ফুয়াদের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাইফুল হক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম মহসিন, সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য শাহীন হাসনাত প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাদেকুর রহমান।
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, যেসব দেশে মানবিক করিডর পরিচালিত হয়েছে এমন অনেক জায়গাতেই অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি।
অনেক জায়গায় নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন হয়নি এমন জায়গায় বিবদমান কোনো কোনো পক্ষ এই প্যাসেজে আক্রমণ করার নজির আছে। এমনকি অনেক জায়গায় মানবিক করিডরে হামলায় সিভিলিয়ানের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আবার কোনো জায়গায় এমন করিডরে থাকা স্থাপনা উড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তাই এমন করিডরের রাজনৈতিক ও সামরিক অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকে। আবার অস্ত্র পাচার এবং দখল করা এলাকায় জ্বালানি চোরাচালানের জন্যও এই করিডর ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তিনি বলেন, আমাদের বুঝতে হবে মানবিক করিডরের সফলতা নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর। যে অঞ্চলে মানবিক করিডর হবে, সেখানকার বিবদমান পক্ষ একমত হলে করিডর পরিচালনা সহজ হয়। কিন্তু সবাই রাজি না হলে তা ব্যর্থ হয়।
আরমেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের (নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ) সময় ১৯৮৯ সালে লাচিন করিডোর স্থাপিত হলেও সেটি দুই বছরের মধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছিল আজারবাইজান সরকার। আবার ১৯৯৩ সালে নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে সেব্রেনিৎসা ছিটমহলকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে ওই বছরেই আরেক প্রস্তাবের মাধ্যমে সারায়েভো, জেপা, গোরাজদে, তুজলা ও বিহাচকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে মোট ছয়টি মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু নিরাপদ এলাকাগুলোকে কীভাবে সুরক্ষিত রাখা হবে তার কোনো রূপরেখা ছিল না। ফলে ১৯৯৫ সাল নাগাদ সেব্রেনিৎসায় গণহত্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এটি ছিল ইউরোপের ভয়াবহ নৃশংসতার একটি। ইয়েমেনের চলমান যুদ্ধের মধ্যে বারবার এমন করিডরের আহ্বান জানিয়েও সফল হয়নি জাতিসংঘ।
আফ্রিকার কঙ্গোয় ২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং জেনারেল লরেন্ট নকুন্ডার নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করলে জাতিসংঘের প্রস্তাবে গোমা অঞ্চলে একটি মানবিক করিডোর খোলার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সেটি শেষ পর্যন্ত সামরিক নানা বিষয়ে জড়িয়ে ব্যর্থ হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে করিডর হলে সেখানে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেখানে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, এখন মিয়ানমার সরকার যদি দেখে এই করিডোরের ফলে আরাকান আর্মি লাভবান হচ্ছে। তখন তারা কি বসে থাকবে? তখনই সমস্যাটা তৈরি হবে। তখন এই করিডরই আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে।
কমরেড সাইফুল হক বলেন, রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের মানবিক করিডোর মূলত একটি ভূরাজনৈতিক পন্থা। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামরিক হস্তক্ষেপের একটি ভিত্তি গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে কৌশলগত ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
তিনি বলেন, রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার চিন্তা চালু হয়েছে, যেখানে শুধু মানবিক সহায়তা নয়, বরং একটি নিয়ন্ত্রিত এলাকা তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সামরিক অংশগ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হতে পারে।
সূত্র: নিউজ টোয়েন্টিফোর