সর্বশেষ
লিটারে তেলের দাম ৩৫ টাকা বাড়াল টিসিবি
ইহরাম অবস্থায় অলঙ্কার-চুড়ি পরা জায়েজ?
৪ দাবিতে লাগাতার অসহযোগ কর্মসূচির ঘোষণা এনবিআর কর্মকর্তাদের
মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের হয়রানির ঘটনায় জামায়াতের উদ্বেগ
ব্যারিকেড ভেঙে ইসি ভবনের সামনে এনসিপি নেতাকর্মীরা
দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে ইশরাকের সমর্থকদের স্লোগান
সেনাবাহিনীকে নিয়ে ভুয়া তথ্যে সয়লাব, রয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যমও
শিশু আছিয়া হত্যা মামলা: ডেথ রেফারেন্সের নথি হাইকোর্টে
নোবেলের বিরুদ্ধে ১১ অভিযোগ
৬৪ জেলার ওপর দিয়ে ‘ধামাকা’ চলবে
বুকার জয় করে ইতিহাস গড়লেন কন্নড় লেখিকা বানু মুশতাক
মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টদের জন্য বড় সুখবর
‘করিডর নিয়ে আমাদের সঙ্গে কারও কোনো কথা হয়নি, হবেও না’
বাংলাদেশ সিরিজের পাকিস্তান দলে নেই বাবর-রিজওয়ান
কুয়েটের অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্যের প্রতি অনাস্থা শিক্ষক সমিতির  

যে মাটিতে আধ্যাত্মিকতার বীজ বুনেছেন হজরত শাহ জালাল ইয়ামেনি

অনলাইন ডেস্ক

পৃথিবীর যেদিকেই তাকাই মহান রাব্বুল আলামীনের কুদরতের যেন শেষ নেই। আমরা হয়তো অনেক সময় মা-বাবা, কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে ঘুরতে যাই। আবার অনেক সময় প্রতিষ্ঠান থেকেও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়। যেটাকে আমরা বলি শিক্ষা সফর। এটি ভ্রমণ থেকে জ্ঞান অর্জনকে বুঝায়।

আমাদের একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন জ্ঞান শুধুমাত্র বই থেকে অর্জন করা যায় না, জ্ঞান অর্জন করতে চাইলে আমাদেরকে অবশ্যই প্রকৃতির সান্নিধ্যে যেতে হবে। ঠিক তখনই অনুধাবন করতে পারব আল্লাহর সৃষ্টি কতই না সুন্দর।

একজন ফরাসি ঔপন্যাসিক নাম গুস্তাভ ফ্লুবেয়ার। তিনি ভ্রমণ নিয়ে চমৎকার একটি কথা বলেছেন, তিনি বলেছেন, ‘ভ্রমণ মানুষকে বিনয়ী করে তোলে এবং জানতে পারে দুনিয়ার তুলনায় সে কত ক্ষুদ্র।’

আসলেই তো আমরা যখন প্রকৃতির মাঝে দাঁড়াই, প্রকৃতির তুলনায় আমরা কতই না ক্ষুদ্র!  কিন্তু সেটা কি আমরা অনুভব করি! ভ্রমণের কথা আসলেই একজন বিখ্যাত পরিব্রাজকের কথা না বলেই নয়! পরিব্রাজক বলাতে নিশ্চয়ই আপনাদের  মাথায় একটি নাম বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে?  তাই না! হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, তিনি আর কেউ নন,  তিনি হলেন বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে বতুতা। যিনি ইবনে বতুতা নামেই সমধিক পরিচিত।

আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, এই বিখ্যাত পরিব্রাজক বাংলাদেশেও এসেছিলেন।  সেই কথা না হয় পরে বলি। চলুন আগে তার সম্পর্কে জেনে আসি।

আজ থেকে প্রায় ৬৮০ বছর পূর্বে মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি একাই মরক্কোর তানজাহ শহর ত্যাগ করেন হজ করার উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ ২৯ বছর তিনি ঘুরেছেন বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশ।

তখনকার সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এত আধুনিক ছিল না। সুদীর্ঘ এই সময়ে ঘোড়া, ঘোড়ার গাড়ি, উট, নৌকা এবং পায়ে হেঁটে বর্তমান সময়ে প্রায় ৪৪টি দেশ ঘুরে পাড়ি দিয়েছিলেন ৭৫, ০০০ মাইল। তার সঙ্গে বহু বিভিন্ন দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, সুফিসাধকসহ অনেকের দেখা হয়। তিনি এসব আবার লিপিবদ্ধ করে গেছেন তার নিজের লেখা গ্রন্থ ‘ রিহলা বা সফরনামা’য়।

এত কথা বলার পেছনে কারণ হলো এই বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক আমাদের বাংলায় এসেছিলেন তাও আবার চট্টগ্রাম দিয়ে। এটি আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগের কথা। তখন ছিল ইংরেজি ১৩৪৫/ ১৩৪৬ সাল।

বাংলার সুলতান ছিলেন ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ। তিনি সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের সঙ্গে দেখা করতে সুদূর মরক্কো থেকে এখানে আসেননি। তিনি এসেছিলেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এক মহান অলির সঙ্গে দেখা করতে, বাংলার বিখ্যাত দরবেশের সান্নিধ্য লাভ করতে। তিনি ছিলেন হজরত শাহজালাল (রহ.)।

বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা যদি বাংলায় আসেন হজরত শাহ জালালের (রহ.) সঙ্গে দেখা করতে তাহলে একবার ভাবুন তো হজরত শাহ জালাল (রহ.) কতই না বড় মাপের দরবেশ ছিলেন! তিনি শুধুমাত্র আজকের জন্য বিখ্যাত তা কিন্তু নয় তিনি আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগেও বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু আমরা তাকে কতটুকু জানি?

গৌড় গোবিন্দের সঙ্গে যুদ্ধ, জালালি কবুতরের গল্প কিংবা জায়নামাজে চড়ে নদী পার এখানেই শেষ নয় হজরত শাহ জালালের (রহ.) মহত্ত্ব।

তিনি সেই সুদূর ইয়েমেন থেকে সিলেটে এসেছিলেন ইসলামের সুমহান বাণী নিয়ে। কিন্তু সিলেট কেন? নিশ্চয়ই এই প্রশ্নটা মনে মনে উঁকি দিচ্ছে! আসলে কি জানেন!  প্রতিটি শহর গড়ে ওঠার পেছনে কোনো না কোনো অলি বা সুফিসাধকদের অবদান থাকে। সেটি আমরা স্বীকার করি আর নাই করি। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়- মূলত দরগাহ বা সুফিসাধকদের মাজারকে কেন্দ্র করে জনপদ, স্থান, জেলা, বিভাগ ইত্যাদি বিস্তৃত হয়েছে।

একবার ভাবুন তো! আরবের মরুপ্রান্তর হয়ে বহু সুফিসাধক, পীর আউলিয়া ইসলামের আধ্যাত্মিক বাণী নিয়ে এই বাংলায় আসেন। তারা ভোগ বিলাসে জীবন কাটানোর জন্য আসেননি। এখানে আসার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল তা হলো মানুষের মন জয় করা, তবে জোর করে নয়, কথা ও কর্ম দিয়ে। তাও আবার ইসলামের আধ্যাত্মিক বাণী দিয়ে।

ফিরে আসি সিলেট বিভাগের কথায়। সিলেটকে আবাদ করেছেন যিনি তিনি হলেন হজরত শাহজালাল (রহ.)। তার পূর্ণ নাম শায়খুল মাশায়েখ মখদুম শায়েখ জালাল উদ্দীন আল মুজররাদ ইবনে মুহম্মদ। যিনি হজরত শাহজালাল নামে পরিচিতি লাভ করেন।

ধারণা করা হয়, ৭০৩ হিজরি মোতাবেক ১৩০৩ খ্রিষ্ট্রাব্দ ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে তিনি সিলেট অঞ্চলে এসেছেন। মৌলভি মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন হায়দার ‘সোহেলী এমন’ নামে ( ১৮৬০ সালে  ফার্সি ভাষায় প্রকাশিত)  হজরত শাহ জালাল( র.) জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন।

সোহেলী গ্রন্থে উল্লেখিত তথ্য থেকে জানা যায়, ৬৭১ হিজরী (১২৭১ খ্রিষ্টাব্দে) হজরত শাহ জালাল (রহ.) জন্মগ্রহণ করেছেন। তার জন্মভূমি ছিল প্রাচীন আরব হেজাজ ভূমির তৎকালীন প্রদেশ ইয়ামেন দেশের কুনিয়া নামক শহরে।

হজরত শাহ জালাল (রহ.) যখন তিন মাসের শিশু, তখনই তার মাতা ইন্তেকাল করেন। তিনি শিশুকালেই মাতৃহীন হন এবং পাঁচ বছর বয়সে পিতাকে হারান। মামা আহমদ কবির তাকে দত্তক নেন। আহমদ কবিরও ছিলেন একজন দরবেশ। তিনি আরবি ভাষায় কুরআন-হাদিস শিক্ষা দেওয়াসহ ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক বিষয়ে (নামাজ, রোজা) অভ্যস্ততার গুরুত্ব প্রদান করেন।

পরবর্তীতে আহমদ কবীর হজরত শাহ জালালকে (রহ.) ইয়েমেন থেকে মক্কায় নিয়ে যান। মক্কা শহরে আহমদ কবীরের একটি আস্তানা (হুজরা) ছিল। সেখানে অন্যান্য শিষ্যদের সঙ্গে হজরত শাহ জালালকেও (রহ.) উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন বলে জানা যায়।

রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটন নামে একজন আমেরিকান ইতিহাসবিদ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, হজরত শাহ জালালের (রহ.) প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ইবনে বতুতার মাধ্যমে।  ১৩৪৫ সালে ইবনে বতুতা সিলেটের কাছে এক পাহাড়ি গুহায় হজরত শাহ জালালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মরক্কোর এই পরিব্রাজক শাহ জালালকে বয়স্ক দরবেশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

লেখার শুরুতে বলেছিলেন, তিনি এত দেশ ঘুরে কেন হিন্দুস্তান হয়ে এই বাংলায় অর্থাৎ সিলেটে আসেন? এটি নিয়ে একটি কাহিনী আছে।

হজরত শাহ জালাল (রহ.) ছিলেন ইয়েমেনের অধিবাসী। সেই দেশের এক রাজার পুত্র ছিলেন শেখ আলি। রাজার মৃত্যুর পর পুত্র শেখ আলি হলেন রাজ্যের রাজা। কিন্তু তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন রাজত্ব ছেড়ে দিয়ে সফরসঙ্গী হবেন হজরত শাহ জালালের সঙ্গে। শাহ জালাল (রহ.) তাকে অনেক বোঝাতে চাইলেন যে তুমি তোমার জায়গায়  বসে রাজ্যে সত্য ও ন্যায়ের আলো জ্বালিয়ে দাও এবং গরিবের প্রতি একজন নিষ্ঠাবান রাজার যে দায়িত্ব, তা পালন করো, কারণ এতেই রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি।

শেখ আলি তার সব উপদেশ নীরবে শুনলেন ঠিক কিন্তু পরমুহূর্তে করজোড়ে পুনরায় তার সঙ্গী হওয়ার জন্যে মিনতি প্রকাশ করলেন। অবশেষে তিনি আর না করতে পারলেন না।

হজরত শাহ জালালের পির আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি যে মাটি তাকে দিয়েছিলেন, সেই মাটি শেখ আলির হাতে দিয়ে বললেন, আমরা যখন যেখানে গিয়ে পৌঁছাব, সেখানকার মাটির সঙ্গে এই মাটির রূপ-রস-গন্ধ তোমাকে মিলিয়ে দেখতে হবে, এটাই হলো তোমার কাজ।

শেখ আলিকে জিহ্বা দিয়ে চুষে মাটি নিরীক্ষণ করতে হতো, সে কারণে আজও তাকে চাষনি পির নামে অভিহিত করা হয়। একেই বলে গুরুর প্রতি ভক্তি, প্রেম। রাজত্বের এত লোভনীয় আকর্ষণ ত্যাগ করে শাহ জালালের প্রতি এতটাই অনুরক্ত ছিলেন যে যার কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাহ জালাল (রহ.) তাকে তার ভক্ত ও সফরসঙ্গী না করে পারলেন না।

যে সময়টাতে তিনি দিল্লি পৌঁছান, তখন ছিল সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির রাজত্বকাল। আর দিল্লির আধ্যাত্মিক মসনদে আসীন ছিলেন চিশতিয়া তরিকার প্রবাদপুরুষ হজরত খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া।

সেই সময়ও ধর্মীয় আলেম সম্প্রদায় খাজা নিজামউদ্দিনের কানে শাহ জালালের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ তোলেন। কিন্তু তিনি শাহ জালালকে (রহ.) আধ্যাত্মিক জগতের মহাপুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

ফার্সিতে একটা কথা আছে, ‘ওয়ালি রা ওয়ালি শানাসাদ’, অর্থাৎ একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিই আরেকজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিকে চিনতে পারেন৷ কিংবদন্তি আছে, খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া (রহ.) তাকে অত্যন্ত স্নেহ ও আতিথেয়তা প্রদান করেন  এবং সেখান থেকে বাংলায় আসার সময় তিনি তাকে প্রীতি নিদর্শনস্বরূপ এক জোড়া কবুতর দেন। আজও তার দরগাহতে যে কবুতরগুলো দেখতে পায় সেগুলো খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়া ( র.) দেওয়া কবুতর। যা জালালি কবুতর নামে পরিচিত।

সেই যে চাষনী পীরের কথা বলেছিলাম, তিনি সিলেটে এসেই মাটি নিরীক্ষণ কাজে লেগে গেলেন। এভাবে দীর্ঘ দিন ঘোরাঘুরির পর সিলেট শহরের একপাশে আম্বরখানার কাছেই এক টিলা খুঁজে পেলেন, যে টিলার মাটির সঙ্গে আরবের শাহ জালালের গুরুর দেয়া মাটির পুরোপুরি মিল পাওয়া যায়। রং-গন্ধ-স্বাদ হুবহু মিল।

মাটিটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত মনে দৌঁড় দিলেন শাহ জালালের কাছে। এরপর হজরত শাহ জালাল আরবের মাটি ও সিলেটের সেই মাটি পাশাপাশি রেখে হাসিমুখে ভক্তদের বললেন, আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহ অভীষ্ট লক্ষ্যে  পৌঁছে দিয়েছেন। অবশেষে ৩৬০ জন অনুসারী নিয়ে দীর্ঘ এক সফরের সমাপ্তি ঘটে এই বাংলায়।

লেখক: প্রভাষক,ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম।

ইসলামের ইতিহাস

সম্পর্কিত খবর

এই পাতার আরও খবর

সর্বশেষ