পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি) জাফর হোসেন টাকা ছাড়া কিছুই বোঝেন না। যোগদানের পর থেকেই অফিসের একটি ফ্ল্যাট দখল করে (গেস্ট হাউজে) থাকছেন। তিন বেলার খাবার, দৈনন্দিন বাজার, আসবাসপত্র ও অন্যান্য খরচ; তার সবই চলে অফিসের টাকায়।
এছাড়াও মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ঘুস আদায়, পিবিআইর জায়গা ভাড়া দিয়ে টাকা আদায়, অফিসের জিমের মালামাল নিজের রুমে রাখা, অফিসের নির্ধারিত জায়গার ফল বিক্রির টাকা আত্মসাৎ, স্টাফদের সঙ্গে অসদাচরণসহ অভিযোগের অন্ত নেই জাফর হোসেনের বিরুদ্ধে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
জানা যায়, জাফর হোসেন চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি পিবিআই মৌলভীবাজার কার্যালয়ে পুলিশ সুপার হিসাবে যোগদান করেন। এর আগে তিনি ঢাকা লালবাগ বিভাগের ডিসি ছিলেন। সেখানে দায়িত্ব পালনকালে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (সেবা) পিপিএম পান। ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে সুপারনিউমারারি (নির্দিষ্ট সংখ্যার অতিরিক্ত পদ) হিসাবে হয়েছেন অতিরিক্ত ডিআইজি। জুলাই-বিপ্লবে বিতর্কিত অবস্থানের কারণে ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলাও হয়েছে। এর পরও বেপরোয়া চলাফেরা করছেন জাফর হোসেন। পতিত স্বৈরাচারের গুপ্তচর হিসাবে মৌলভীাবজার থেকে ভূমিকা রাখার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মৌলভীবাজারে যোগদানের প্রথম দিন থেকেই অফিসের দ্বিতীয় তলার নির্ধাতির এক ইউনিটের গেস্ট হাউজে ওঠেন। গেস্ট হাউজে তিনটি বেড রুম, একটি ড্রয়িং ও একটি ডাইনিং রুম এবং ভিআইপি আসবাবপত্র রয়েছে। এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত (শুক্রবার) তিনি এই গেস্ট হাউজেই থাকছেন। পরিবারের সদস্যরা এলেও সেখানে রাখেন। অফিসের বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, এসি ও আসবাবপত্র ব্যবহার করেন।
জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় জানায়, বাসা ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে ২৩ হাজার ৯৬১ টাকা দিচ্ছে। কিন্তু জাফর হোসেন সরকারি গেস্ট হাউজে থেকেও নিচ্ছেন বাসা ভাড়ার টাকা।
সূত্র জানায়, অফিসের কয়েকজন স্টাফ মেচ করে খাওয়া-দাওয়া করেন। ওই মেচেই পুলিশ সুপার জাফর হোসেনের জন্য প্রতি বেলা আলাদা করে খাবার রান্না করেন বাবুর্চি মোস্তাক। তার বাজারের যাবতীয় খরচ অফিসের টাকা দিয়েই করা হয়। এছাড়া স্টাফদের ব্যবহারের জন্য সরকারি বরাদ্দে জিমের মালামাল কেনা হয়। তিনি আসার পরই জিমের সরঞ্জমাদি গেস্ট হাউজে নেন এবং একাই ব্যবহার করছেন।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতি মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা যাতায়াত খরচ বাবদ দুই হাজার টাকা পান। জাফর হোসেন যোগদান করেই আগের প্রায় ৬০টি এবং সম্প্রতি সময়ে হওয়া মামলায় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অফিস খরচের কথা বলে ৫০০ টাকা করে কেটে রাখেন।
সূত্র বলছে, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে সিভিল মাইক্রোবাস নিয়ে ঢাকায় যান অতিরিক্ত ডিআইজি জাফর হোসেন। গাড়ি ঢাকায় রেখে চালক ইব্রাহিমকে মৌলভীবাজার পাঠিয়ে দেন। দাপ্তরিক এই গাড়ি দিয়েই ঢাকায় চারদিন ঘোরাফেরা করেন। পরে চালক ইব্রাহিমকে ঢাকায় নিয়ে এ গাড়ি মৌলভীবাজার নিয়ে আসেন। অতিরিক্ত ডিআইজি জাফর হোসেন লালবাগ জোনে থাকাবস্থায় তার বর্ডিগার্ড ছিলেন কনস্টেবল নাজমুল ইসলাম। জাফর হোসেন মৌলভীবাজার আসার পরপরই সেই নাজমুলকেও বদলি করে নিয়ে আসেন। ১০ এপ্রিল স্ত্রী ও ছেলে মৌলভীবাজার এলে তাদের নিয়েই অফিসের গেস্ট হাউজে থাকেন। ৫ দিনই জেলার দর্শনীয় স্থানে সরকারি গাড়ি নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। ছুটি না নিয়ে এই পাঁচ দিন অফিসের বাহিরে থাকেন।
জানা যায়, পিবিআই মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্ধারিত জায়গা রয়েছে শহরের টেকনিক্যাল স্কুল রোডে। জায়গার পাশেই মো. জালাল উদ্দিনের বাসায় নির্মাণ কাজ চলছে। নির্মাণসামগ্রী রাখার জন্য মো. জালাল উদ্দিন ১২ হাজার টাকা দিয়ে জাফর হোসেনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছেন।
মো. জালাল উদ্দিনের ভাগিনা মোফাজ্জল উদ্দিন বলেন, ‘পিবিআই অফিসে গিয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি স্যারের সঙ্গে কথা বলে ১২ হাজার টাকায় এপ্রিল মাসে ভাড়া নিয়েছি। এ টাকা ড্রাইভার ইব্রাহিমের কাছে দিয়েছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ জায়গায় একটি লিচু গাছ রয়েছে। বিগত মৌসুমে অফিসের স্টাফরা লিচু ভাগ করে খেতেন। এবার ৭ হাজার টাকায় খোকন নামে একজনের কাছে বিক্রি করেছেন। আর স্টাফদের ২০ পিস করে লিচু দেওয়া হয়।
পিবিআই মৌলভীবাজার কার্যালয়ের ইন্সপেক্টর হিল্লুল রায় বলেন, স্যার অফিসে থাকেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গেস্ট হাউজের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা কী, আমার জানা নেই।
পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি) জাফর হোসেন বলেন, ‘গেস্ট হাউজে থাকার আমাদের সেন্ট্রালি একটি নির্দেশনা আছে, তাই থাকছি।
সিভিল মাইক্রোবাস ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, মেরামত কাজের জন্য নেওয়া হয়েছিল। মামলা বাবদ তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অবগত আছেন। অন্যান্য বিষয়ে জানতে চাইলে অফিসে আসেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।’
সূত্র: যুগান্তর
পিবিআই মৌলভীবাজার ডিআইজি