উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
রাজার বাগানের কোণে টুনটুনির বাসা ছিল। রাজার সিন্দুকের টাকা রোদে শুকোতে দিয়েছিল, সন্ধ্যার সময় তাঁর লোকেরা একটি টাকা ঘরে তুলতে ভুলে গেল।
টুনটুনি সেই চকচকে টাকাটি দেখতে পেয়ে তার বাসায় এনে রেখে দিল, আর ভাবল, ‘ইশ! আমি কত বড়লোক হয়ে গেছি। রাজার ঘরে যে ধন আছে, আমার ঘরে সে ধন আছে!’ তারপর থেকে সে খালি এই কথাই ভাবে, আর বলে—
‘রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরে সে ধন আছে।’
রাজা তাঁর সভায় বসে সে-কথা শুনতে পেয়ে জিগগেস করলেন, ‘হ্যারে। পাখিটা কী বললে রে?’
সকলে হাতজোড় করে বলল, ‘মহারাজ, পাখি বললে, আপনার ঘরে যে ধন আছে, ওর ঘরেও নাকি সেই ধন আছে!!
শুনে রাজা খিলখিল করে হেসে বললেন, ‘দেখ তো ওর বাসায় কী আছে।’
তারা দেখে এসে বলল, ‘মহারাজ, বাসায় একটি টাকা আছে।’
শুনে রাজা বললেন, ‘সে তো আমারই টাকা, নিয়ে আয় সেটা।’
তখুনি লোক গিয়ে টুনটুনির বাসা থেকে টাকাটি নিয়ে এল। সে বেচারা আর কী করে, সে মনের দুঃখে বলতে লাগল—
‘রাজা বড় ধনে কাতর টুনির ধন নিলে বাড়ির ভিতর!’
শুনে রাজা আবার হেসে বললেন, ‘পাখিটা তো বড় ঠ্যাঁটা রে। যা, ওর টাকা ওকে ফিরিয়ে দিয়ে আয়।’
টাকা ফিরে পেয়ে টুনির বড় আনন্দ হয়েছে। তখন সে বলছে—
‘রাজা ভারি ভয় পেল টুনির টাকা ফিরিয়ে দিল।
রাজা জিগগেস করলেন, ‘আবার কী বলছে রে?”
সভার লোকেরা বলল, ‘বলছে যে মহারাজা নাকি বড্ড ভয় পেয়েছেন, তাই ওর টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন।’
শুনেই তো রাজামশাই রেগে একেবারে অস্থির। বললেন, ‘কী, এতবড় কথা। আন তো ধরে, বেটাকে ভেজে খাই।’
যেই বলা অমনি লোক গিয়ে টুনটুনি বেচারাকে ধরে আনল। রাজা তাকে মুঠোয় করে নিয়ে বাড়ির ভিতর গিয়ে রানিদের বললেন, ‘এই পাখিটাকে ভেজে আজ আমাকে খেতে দিতে হবে।’
বলে তো রাজা চলে এসেছেন, আর রানিরা সাতজনে মিলে সেই পাখিটাকে দেখছেন।
একজন বললেন, ‘কী সুন্দর পাখি। আমার হাতে দাও তো একবার দেখি।’ বলে তিনি তাকে হাতে নিলেন। তা দেখে আবার আর-একজন দেখতে চাইলেন। তাঁর হাত থেকে যখন আর-একজন নিতে গেলেন, তখন টুনটুনি ফসকে গিয়ে উড়ে পালাল।
কী সর্বনাশ। এখন উপায় কী হবে? রাজা জানতে পারলে তো রক্ষা থাকবে না।
এমনি করে তাঁরা দুঃখ করছেন, এমন সময় একটা ব্যাঙ সেইখান দিয়ে থপথপ করে যাচ্ছে।
সাতরানি তাকে দেখতে পেয়ে খপ করে ধরে ফেললেন, আর বললেন, ‘চুপ চুপ। কেউ যেন জানতে না পারে। এইটাকে ভেজে দি, আর রাজামশাই খেয়ে ভাববেন টুনটুনিই খেয়েছেন।’
সেই ব্যাঙটার ছাল ছাড়িয়ে তাকে ভেজে রাজামশাইকে দিলে তিনি খেয়ে ভারি খুশি হলেন। তারপর সবে তিনি সভায় গিয়ে বসেছেন, আর ভাবছেন, ‘এবার পাখির বাছাকে জব্দ করেছি।’
অমনি টুনটুনি বলছে— ‘বড় মজা, বড় মজা, রাজা খেলেন ব্যাঙ ভাজা!’
শুনেই তো রাজামশাই লাফিয়ে উঠেছেন। তখন তিনি থুতু ফেলেন, ওয়াক তোলেন, মুখ ধোন, আরও কত কী করেন। তারপর রেগে বললেন, ‘সাতরানির নাক কেটে ফেল।’
অমনি জল্লাদ গিয়ে সাতরানির নাক কেটে ফেলল।
তা দেখে টুনটুনি বলল— ‘এক টুনিতে টুনটুনাল সাতরানির নাক কাটাল।’
তখন রাজা বললেন, ‘আন বেটাকে ধরে! এবারে গিলে খাব। দেখি কেমন করে পালায়!’
টুনটুনিকে ধরে আনল। রাজা বললেন, ‘আন জল!” জল এল। রাজা মুখভরে জল নিয়ে টুনটুনিকে মুখে পুরেই চোখ বুজে ঢক করে গিলে ফেললেন।
সবাই বলল, ‘এবারে পাখি জব্দ।’ বলতে-বলতেই রাজামশাই ভোক করে মস্তবড় একটা ঢেকুর তুললেন। সভার লোক চমকে উঠল, আর টুনটুনি সেই ঢেকুরের সঙ্গে বেরিয়ে এসে উড়ে পালাল।
রাজা বললেন, ‘গেল, গেল। ধর, ধর। অমনি দুশো লোক ছুটে গিয়ে বেচারাকে আবার ধরে আনল।
তারপর আবার জল নিয়ে এল, আর সিপাই এসে তলোয়ার নিয়ে রাজামশায়ের কাছে দাঁড়াল, টুনটুনি বেরুলেই তাকে দুই-টুকরো করে ফেলবে।
এবার টুনটুনিকে গিলেই রাজামশাই দুইহাতে মুখ চেপে বসে থাকলেন, যাতে টুনটুনি আর বেরুতে না পারে। সে বেচারা পেটের ভিতরে গিয়ে ভয়ানক ছটফট করতে লাগল।
খানিকবাদে রাজামশাই নাক সিটকিয়ে বললেন, ‘ওয়াক।’ অমনি টুনটুনিকে সুদ্ধ তাঁর পেটের ভিতরের সকল জিনিস বেরিয়ে এল।
সবাই বলল, ‘সিপাই, সিপাই। মারো, মারো! পালাল!’
সিপাই তাতে থতমত খেয়ে তলোয়ার দিয়ে যেই টুনটুনিকে মারতে যাবে, অমনি সেই তলোয়ার টুনটুনির গায়ে না পড়ে রাজামশায়ের নাকে গিয়ে পড়ল। রাজামশাই তো ভয়ানক চ্যাঁচালেন, সঙ্গে সঙ্গে সভার সকল লোক চ্যাঁচাতে লাগল। তখন ডাক্তার এসে ওষুধ দিয়ে পটি বেঁধে অনেক কষ্টে রাজামশাইকে বাঁচাল।
টুনটুনি তা দেখে বলতে লাগল— ‘নাক কাটা রাজা রে দেখ তো কেমন সাজা রে!’
বলেই সে উড়ে সে-দেশ থেকে চলে গেল। রাজার লোক ছুটে এসে দেখল, খালি বাসা পড়ে আছে।