সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বর্তমান সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী ‘মতপ্রকাশের মঞ্চ’। এখানে কেউ যেমন ভিডিও ছড়িয়ে দিতে পারে, তেমনি গুজব, অপবাদ, তুচ্ছ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও ছড়িয়ে দিতে পারে কয়েক সেকেন্ডে। এসব ভয়াবহতার মধ্যে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো—অপপ্রচারের পেছনের মনোভাব। কারো ব্যক্তিগত শত্রুতা, রাজনৈতিক ঘৃণা, ধর্মীয় বিদ্বেষ বা হিংসার বশবর্তী হয়ে আজ অনেকেই কাউকে ‘ভাইরাল’ করে দিচ্ছে এমনভাবে—যা তার জন্য সামাজিক মৃত্যু ডেকে আনছে।
কাউকে অপমান বা অপবাদ দেওয়ার উদ্দেশ্য হতে পারে সস্তা খ্যাতি অর্জন, নিজের পেজের ‘ভিউ’ বাড়ানো, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা কিংবা ব্যক্তিগত হিংসার আগুনে শয়তানি আনন্দ লাভ করা। এসব উদ্দেশ্য পূরণে মানুষ মিথ্যা গুজব রটায়, বিকৃত ছবি বা ভিডিও প্রচার করে, গোপন তথ্য ফাঁস করে কিংবা ‘অভিযোগ’ নাম দিয়ে পুরো চরিত্রহনন করে ফেলে।
এসব কাজের পেছনে কোনো বিবেক কাজ করে না। ভাবা হয় না এই অপবাদে কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে, সামাজিকভাবে একঘরে হচ্ছে, সংসার ভাঙছে, চাকরি হারাচ্ছে, এমনকি ধর্মীয়ভাবেও নিজেকে কলুষিত মনে করে আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্তের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যদিও আত্মহত্যা ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে কঠোরভাবে হারাম ও চিরস্থায়ী গুনাহ।
ইসলাম এসব অপবাদ ও চরিত্রহননের বিরুদ্ধে এক বিশুদ্ধ নীতিমালা দিয়ে রেখেছে। ইসলামী শরিয়তে কাউকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছোট করা, সম্মানহানি করা, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া কবিরা গুনাহ।
গিবত বা পরনিন্দার ব্যাপারে সাবধান করে পবিত্র কোরআন ঘোষণা করেছে—‘তোমাদের কেউ যেন অপরজনের গিবত না করে। তোমাদের কেউ কি চায়, সে তার মৃত ভাইয়ের মাংস খাবে? নিশ্চয়ই তা তোমাদের কাছে ঘৃণিত।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১২) গিবত হলো এমন কথা বলা যা কাউকে অপমান করে, যদিও তা সত্য। অথচ এখন সামাজিক মাধ্যমে সত্য বা মিথ্যার যাচাই ছাড়াই পরনিন্দামূলক পোস্ট অহরহ করা হচ্ছে।
তোহমত বা অপবাদ বিষয়ে কোরআনুল কারিমের সুরা নূরের ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে— ‘যারা সচ্চরিত্র নারীদের অপবাদ দেয়… তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশাপ এবং কঠিন শাস্তি।’ যখন কাউকে এমন কোনো দোষে অভিযুক্ত করা হয়, যা সে করেনি, তখন তা হয় তোহমত। এটি গিবতের চেয়েও ভয়াবহ।
বুহতান বা মিথ্যা অপবাদ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের মান-ইজ্জতের ক্ষতি করার জন্য এমন কথা বলে যা সত্য নয়, সে জাহান্নামে স্থান পাবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৮১)
বর্তমানে কিছু সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে ধর্মীয় আলেম, দ্বীনি সংগঠন বা সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো। উদ্দেশ্য মানুষের মন থেকে তাদের ভালোবাসা কমানো, দ্বীনি প্রভাবকে দুর্বল করা। অথচ এসব কাজকে তারা ‘পরামর্শ’ বা ‘সচেতনতা’ বলেই চালিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। যেন এতে কোনো গুনাহ নেই। বাস্তবে এটি ইসলামি নীতিমালার চরম লঙ্ঘন। অথচ কাউকে উপদেশ বা পরামর্শ দেওয়ার কোরআনি ও নববী পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো হিকমত ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ১২৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কারো কোনো দোষ জানতে পারতেন, তিনি নাম প্রকাশ না করে বলতেন, ‘কী হয়েছে সেইসব লোকদের, যারা এমন কথা বলে?’ (মুসলিম, হাদিস : ৩০০৪)
কাজেই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে—
১. সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়ার আগে যাচাই করা যে ‘এটি সত্য কিনা?’
২. কাউকে অপবাদ দিতে দেখলে—তাকে বোঝানো, কারণ এটা দুনিয়া ও আখিরাতে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে।
৩. কারো যদি বদনামের শিকার হওয়ার কথা জানতে পারি—তাকে সহানুভূতি ও সহযোদ্ধার মনোভাব দেখানো, যেন সে মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে।
৪. সন্তান, বন্ধু ও পরিচিতজনদের শেখানো— ‘মানুষের সম্মান নষ্ট নয়, রক্ষা করাই ধর্মীয় দায়িত্ব।’
সম্মানহানি নয়, সম্মান রক্ষা হোক আমাদের চরিত্রের পরিচয়। সোশ্যাল মিডিয়া হোক কল্যাণের মাধ্যম—কুত্সা, ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের নয়। নববী আদর্শ হোক আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ বিনির্মাণের আয়না। আল্লাহ আমাদের সকলকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক