উমাইয়া রাজবংশের শেষ খলিফা হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মারওয়ান ইবনে হাকাম। তাঁর শাসনামলে উমাইয়া খিলাফতের রাজধানী ছিল সিরিয়ার ঐতিহ্যবাহী নগরী দামেস্ক।
১২৭ হিজরিতে আল-ওয়ালিদ ইবনে ইয়াজিদ এবং ইয়াজিদ ইবনে আল-ওয়ালিদের মৃত্যুর পর, এবং ইবরাহিম ইবনে ইয়াজিদ ইবনে আবদুল মালিকের ক্ষমতাচ্যুতির প্রেক্ষিতে তিনি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। খলিফা মারওয়ান, যিনি তাঁর শিক্ষক জাদ ইবনে দিরহামের নামানুসারে মারওয়ান আল-জাদি নামেও পরিচিত ছিলেন, ছিলেন এক বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। যুদ্ধক্ষেত্রে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার জন্য তাঁকে কৌতুকচ্ছলে ‘গাধা’ ডাকনামেও অভিহিত করা হতো, যা সেই সময়ে একটি সাহসী ও কঠিন মানসিকতার প্রতীক হিসেবেই ব্যবহৃত হতো।
৭২ হিজরিতে জন্মগ্রহণকারী এই খলিফার বাহ্যিক অবয়ব ছিল চমকপ্রদ উজ্জ্বল সাদা মুখ, ঘন দাড়ি, সুঠাম দেহ এবং এক অসাধারণ রাজকীয় আভিজাত্য তাকে অনন্য করে তুলেছিল। তিনি কেবল শারীরিকভাবে বলিষ্ঠই ছিলেন না, ছিলেন সাহস, কৌশল, ধৈর্য, সাহিত্যপ্রেম এবং বাগ্মীতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি ষাটের কোটা পেরিয়ে ৬২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ইতিহাস তাকে স্মরণ করে একজন দৃঢ়চেতা ও প্রজ্ঞাবান শাসক হিসেবেই, যিনি চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও একাগ্রতা ও দক্ষতার সঙ্গে খিলাফতের ভার বহন করেছিলেন। উমাইয়া খিলাফতের পতন ও আব্বাসীয় উত্থান
মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদের শাসনকাল ছিল সংঘাত, বিভ্রান্তি ও অস্থিরতায় পরিপূর্ণ। উমাইয়া শাসনের শেষ অধ্যায়ে এসে চারদিকে বিদ্রোহ, গণঅসন্তোষ এবং শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তাঁর শাসনামলেই উমাইয়া খিলাফতের পতনের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। ১২৯ হিজরিতে আব্বাসীয় আন্দোলন নতুন উদ্দীপনায় ও সংগঠিতভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। প্রথমেই খলিফা মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদ সেই বিদ্রোহের প্রধান নেতাকে বন্দী করে মৃত্যুদণ্ড দেন। কিন্তু বিদ্রোহ থেমে থাকেনি। নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তার ভাই, আবু আল-আব্বাস আল-সাফাহ—যিনি পরে ইতিহাসে আব্বাসীয় খিলাফতের প্রথম খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। আব্বাসীয় নেতা কুফায় অবস্থান নেন এবং অল্প সময়েই ইরাক ও খোরাসানের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন।
এরপর দুই প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে মসুল ও এরবিলের মধ্যবর্তী অঞ্চলের জাব নদীর তীরে। এই যুদ্ধেই ভাগ্য নির্ধারণ হয় মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদের। তিনি পরাজিত হয়ে পিছু হটেন এবং একের পর এক অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে থাকেন আত্মরক্ষার আশায়। অবশেষে, মিশরে তিনি আব্বাসীয় বাহিনীর হাতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে উমাইয়া খিলাফতের অবসান ঘটে এবং বিশ্বমঞ্চে আব্বাসীয় খিলাফতের সূচনা ঘটে।