কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে শিক্ষানবিশ এক নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ভারতের হাসপাতালগুলোতে নিরাপত্তাকাঠামো ঢেলে সাজানোর নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। ওই চিকিৎসক খুনের ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যে মামলা নিয়েছিলেন, তার শুনানি শেষে এ আদেশ দেওয়া হয়। এছাড়া আরজ কর হাসপাতালে নিরাপত্তায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের আদেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। খবর– এনডিটিভি
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ মঙ্গলবার স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের নিরাপত্তায় টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব দেন। এই টাস্কফোর্সে থাকবেন ৯ জন চিকিৎসক। টাস্কফোর্স মূলত যে দুটি বিষয়ে কাজ করবে সেগুলো হলো, চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের ওপর হিংসা এবং লিঙ্গগত বৈষম্য দূর করা এবং হাসপাতালের চিকিৎসক, ইন্টার্ন, রেসিডেন্ট চিকিৎসকদের কাজের নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করার জন্য একটি প্রটোকল বা নিয়মবিধি তৈরি করা।
হাসপাতালের সব জায়গায় পর্যাপ্ত আলো এবং সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারি রয়েছে কিনা, ভিড় আটকাতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা রয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখবে টাস্কফোর্স। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত পরিবহনব্যবস্থা চালু রাখা যায় কিনা তাও টাস্কফোর্সকে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। এছাড়া রোগী বাদ দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার কেউ যাতে হাসপাতালে ঢুকতে না পারেন, হাসপাতালগুলোকে তা নিশ্চিত করার কথা জানাবে টাস্কফোর্স।
এদিকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভে উত্তাল ভারতে চিকিৎসকরা ২৪ ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করেছেন। চিকিৎসকদের সর্বভারতীয় সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএমএ) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা এ হত্যাকাণ্ডকে ‘নারীদের জন্য নিরাপদ স্থানের অভাবের কারণে বর্বর মাত্রার অপরাধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং তার ‘ন্যায়বিচারের সংগ্রামে’ দেশবাসীর সমর্থন চেয়েছেন। হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং নারীদের সুরক্ষার আহ্বান জানানো হয়েছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেপি নাড্ডাকে চিঠি লিখে আইএমএ তাদের পাঁচ দফা দাবি তুল ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে– নারীদের সুরক্ষার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। বিমানবন্দরের মতো কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখতে হবে হাসপাতালে। চিকিৎসকদের জন্য নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করতে হবে। ভুক্তভোগী পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে আনন্দবাজার লিখেছে, নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে কাজে যোগ দেবেন না তারা। পশ্চিমবঙ্গের হাসপাতালগুলোও অচল হয়ে পড়েছে।
আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার রুমালিকা কুমার অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, তাদের ন্যায়বিচারের দাবি এখনও পূরণ হয়নি। উপযুক্ত প্রমাণসহ সব দোষীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবিও জানিয়েছেন। শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে রুমালিকা বলেন, অস্বচ্ছতার কারণেই কলকাতা পুলিশ থেকে তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তাদের ন্যায়বিচারের দাবি আদৌ পূরণ হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে একই হাসপাতালের চিকিৎসক রিয়া বেরা বলেন, ‘আমরা যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতে সব দোষীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি। সিবিআইয়ের কাছ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক প্রেস বিজ্ঞপ্তি চাচ্ছি। লিখিত ক্ষমা চাইতে হবে তাদের এবং প্রাক্তন অধ্যক্ষসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পদত্যাগ দাবি করছি।’
এদিকে, কলকাতা পুলিশের দাবি, ১৪ আগস্ট আর জি কর হাসপাতাল ক্যাম্পাসে উন্মত্ত জনতার ভাঙচুরের ঘটনায় ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইএমএর এই কর্মবিরতিতে সমর্থন জানিয়ে যোগ দিয়েছেন হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া এবং ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার চিকিৎসকরাও। ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় বলিউডের তারকারাও নিন্দা জানিয়েছেন। সবার কণ্ঠে এক সুর, ‘ন্যায়বিচার চাই’। চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার পাওয়া মেকআপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুণ্ডু তাঁর পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন নিহত চিকিৎসককে।এ ঘটনার প্রতিবাদে নারী চিকিৎসকের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন বলিউড তারকা হৃতিক রোশন, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, কারিনা কাপুর, আয়ুষ্মান খুরানা, টুইঙ্কেল খান্না, আলিয়া ভাট, জাসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ সিরাজ প্রমুখ।
এই নারী চিকিৎসক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জানাজানি হয় ৯ আগস্ট ভোরে। আর জি কর হাসপাতালের চারতলায় দায়িত্ব পালন শেষে সেমিনার কক্ষে বিশ্রাম নিয়েছিলেন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পড়ুয়া নারী চিকিৎসক। সেখানে সকালে তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়। এর পরই উত্তাল হয়ে ওঠে ওই হাসপাতালসহ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। ৯ দিন ধরে চলছে ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও চিকিৎসকদের কর্মবিরতি।
চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক দোষারোপের খেলা শুরু করেছে। বিরোধী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এ ঘটনায় শাসক তৃণমূল কংগ্রেস পার্টিকে (টিএমসি) অভিযুক্ত করেছে। তবে টিএমসি এই অভিযোগ অস্বীকার করে সহিংসতার জন্য ‘রাজনৈতিক বহিরাগতদের’ দায়ী করেছে। পশ্চিমবঙ্গজুড়ে কয়েক হাজার নারী বুধবার রাতে ‘রাত দখল কর’ এবং ‘নির্ভয়ে বাঁচার স্বাধীনতার’ দাবিতে বিক্ষোভে অংশ নেন। দিল্লি, হায়দরাবাদ, মুম্বাই এবং পুনের মতো ভারতের আরও অনেক শহরেও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে।