শহরের চাপা কান্না শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই হুট করে ঘুরে আসা যায় ভারতের ত্রিপুরা থেকে।কী এক অদ্ভুত আবেশ স্মৃতি হয়ে জড়িয়ে রেখেছে। চোখ বুজলেই কল্পনা আলোকচ্ছটার মতো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূরের পাহাড়ের কোলে। এই তো কিছুদিন আগের কথা, পড়াশোনা ও কাজের গহ্বরে আটকে ছিলাম। শহরের চাপা কান্না শুনতে শুনতে দেহ-মন অসাড় হওয়ার অবস্থা। ঠিক করে ফেললাম, এই শহরকে কিছুদিন মুক্তি দিই। আর সেই সঙ্গে নিজেকেও। দেরাজের এক কোণে পড়ে থাকা পাসপোর্টটা খুলতেই মনটা উদাস হয়ে গেল। মাত্র ৭ দিন বাকি। ভিসা করতে দেওয়া, তারপর হাতে পেতে মোটামুটি এক–দেড় মাসের ব্যাপার। মনস্থির করলাম বেরোতে হলে আজ কিংবা কালই। দেশের বাইরে ঘুরতে যাব। জমানো রয়েছে অল্প কিছু টাকা। এই টাকায় কি অন্য দেশে ভ্রমণ সম্ভব! খোঁজ করতে লাগলাম।
হঠাৎ মনে পড়ল, এক বন্ধুর কথা। সেই গত নভেম্বরে বলেছিল অল্প কিছু টাকা জোগাড় করতে। ত্রিপুরা ঘুরতে যাবে। তখন সময় করে ওঠা হয়নি বলে ভ্রমণের চিন্তা বাদ দিয়েছিলাম। মনকে তখন সান্ত্বনা দিলেও একটা চাপা ইচ্ছা কোথাও লুকিয়ে ছিল। মনে পড়তেই স্থির করলাম কালই রওনা করব। ভ্রমণ হয়তো হুটহাট সিদ্ধান্তকেই মেনে নেয়। বেশি জল্পনা–কল্পনা করে ভ্রমণের আয়োজন আমার ক্ষেত্রে হয়ে ওঠেনি কখনো আসলে। সেই বন্ধুকে জানালাম আমার ইচ্ছার কথা। সে রাজি হয়ে গেল।
ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে, কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে, সেই লোভ সামলানো কতটা কষ্টের, সে আমি জানি। ট্রেনের টিকিট না পেলে ইচ্ছা ছিল বাসে যাব। ভাগ্য সহায় ছিল। পরের দিন ভোরবেলা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কমলাপুর থেকে ট্রেন মহানগর প্রভাতি ৭টা বেজে ৪৫ মিনিটে ছাড়ে। চট্টগ্রামের ট্রেন এই মহানগর প্রভাতি। আমরা নামব আখাউড়া স্টেশন। ট্রেন বেশি দেরি করল না। জানালা থেকে বাইরে উঁকি দিয়ে সবুজ দেখতে দেখতে কেমন যেন হারিয়ে গেলাম। অবারিত সবুজের বুক চিড়ে ট্রেন ছুটছে।
আনুমানিক ১০টা ৩৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম আখাউড়া স্টেশনে। স্টেশন থেকে নামতেই রিকশাগুলো সারি বেঁধে দাঁড়ানো। ওরাই ডাকছিল, বর্ডার বর্ডার বলে। উঠে পড়লাম। খুব বেশি ভাড়া নেয়নি। দুজনের ৮০ টাকাতেই হয়ে গেল। মাঠঘাট দেখতে দেখতে ২০ মিনিটের মধ্যেই বর্ডারে পৌঁছে গেলাম। ওখানে নেমে পাসপোর্ট বের করে সামনে এগোলাম। সবকিছুই কাছাকাছি। বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন অফিসের কাজ সেরে ভারতের অ্যারাইভাল ফরম পূরণ আর তথ্য যাচাই শেষ করে আনুমানিক সাড়ে ১১টায় আগরতলায় পা রাখলাম।
বাংলাদেশে আখাউড়াই শেষ পয়েন্ট এখানে। আর ভারতে পা রাখলেই আগরতলা। বর্ডারের সব কাজ করতে এত কম সময় লাগবে ভাবতে পারিনি। আগরতলা ত্রিপুরার অংশ। একটা রিকশা রিজার্ভ করলাম বটতলার উদ্দেশে। অটো ভাড়া লোকাল ২০ রুপি। ১৫ মিনিট লাগল পৌঁছাতে। বটতলাতেই অনেক হোটেল রয়েছে। অনলাইনে খোঁজ নিয়ে বুক করেও রাখতে পারেন। আমাদের মতো এমনি গেলেও পেয়ে যাবেন। যেকোনো সাধারণ হোটেল ভাড়া সর্বনিম্ন ৬০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকার মধ্যেই আছে। আমরা একটা হোটেল ঠিক করে, ফ্রেশ হয়ে, খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নিলাম। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা অনেক হোটেলেই থাকে। আর না থাকলেও আশপাশে খাবার দোকানের অভাব নেই। শহরটা খুব বেশি বড় না। সবকিছুই হাতের নাগালেই।
ঘুম দিয়ে উঠে মনটা কেমন ঝরঝরে হয়ে গেল। আনন্দ আর বিস্ময়ের অনুভূতি অনেক দিন পর নতুন করে খুঁজে পেলাম। বেরিয়ে পড়লাম শহরটা দেখতে। সবচেয়ে ভালো বিষয় হচ্ছে, ত্রিপুরার সবাই বাংলা বোঝে, বাংলায় কথা বলে। আরও অবাক হলাম, যখন অটোর ড্রাইভার বা দোকানদার সিলেটি বা কুমিল্লার টানে কথা বলছে। বরিশালের ভাষাও বাদ পড়েনি। মনে হচ্ছিল বাংলাদেশেই ঘুরছি, হয়তো নতুন কোনো জেলায়। ত্রিপুরার মানুষের চেয়ে এখানে বাঙালিই বেশি দেখলাম। তাঁদের পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের। যখন জানলেন আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি, বেশির ভাগ মানুষের হাসি দেখেছি। বুঝলাম ওনারা বাংলাদেশের মানুষদের পছন্দ করেন। কেউ কেউ তো নিজ থেকেই গল্প শুরু করলেন। ওখানে লোকাল ভাড়া অনেক কম। শুধু বললেই হয় রিজার্ভ যাব না। ত্রিপুরার লোকেরা যথেষ্ট সাবলীল ও সাহায্য করেন সবাইকে।
শহরটা বেশ পরিষ্কার আর সুন্দর। বুক ভরে নেওয়া যায় বিশুদ্ধ বাতাস। প্রথম দিন শহর দেখেই কাটালাম। চা আর মোমো খেলাম। খাবারের দাম যথেষ্ট কম ওখানে। স্বাদও বেশ ভালো তবে এখানকার বিরিয়ানি খেয়ে মন ভরল না। আমাদের ঢাকার বিরিয়ানিকে বিশ্বদরবারে স্বাদের নিরিখে উপস্থাপন করলে অনেক অঞ্চলই পিছিয়ে যাবে। পরের দিনের প্ল্যান করলাম ঠিক হলো শহরের খুব কাছেই উজ্জয়ন্ত প্যালেস দেখতে যাব। কী কী দেখব বা কোথায় ঘুরব, তা মোটামুটি আগে থেকেই আমাদের জানা ছিল। আপনারা ইউটিউবে অজস্র ভ্লগ পাবেন ত্রিপুরা নিয়ে। ওখানকার মানুষদেরও জিজ্ঞাসা করে নিয়েছিলাম কোথায় কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়। তাঁরা যথেষ্ট সাহায্য করেছেন এবং মোটামুটি তাঁদের দেওয়া সব তথ্যই সঠিক ছিল।
উজ্জয়ন্ত প্যালেস বা রাজবাড়ির গল্প
পরের দিন সকালে উঠে নাশতা করে বেরিয়ে পড়লাম। শুনেছিলাম, অটোতে রাজবাড়ি বললেই হবে। অটোওয়ালারা উজ্জয়ন্ত প্যালেসের চেয়ে রাজবাড়ি বললেই বেশি চেনে। লোকাল ভাড়া ১০ টাকা। কিছু সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম।
আমরা প্যালেস বলতে যা বুঝি, উজ্জয়ন্ত তার একটি সঠিক উদাহরণ। এটা লোকাল মিউজিয়াম হিসেবেও পরিচিত, যদিও টিকিট কেটে ঢুকতে হবে। বাংলাদেশিদের জন্য টিকিটের মূল্য জনপ্রতি ১০০ রুপি। অবশ্যই পাসপোর্ট সঙ্গে নিতে হবে। ক্যামেরা নিলে আলাদা চার্জ দিতে হবে ৬০০ রুপি। প্রথম রাজফটক ভেদ করে গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ল ড. বাবা সাহেব ভিমরাও আম্বেদকরের মূর্তি। এর পেছনে তাকাতেই চোখ আটকে গেল সাদা রঙের বিশাল এক রাজমহলের দিকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।
তারপর সামনে হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ল দুপাশে সুন্দর পামগাছের সারি। তার পেছনে দুধারেই লেক। লেকের পানি সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে। আর ঠিক মাঝে রয়েছে ঝরনা। আস্তে আস্তে সামনে এগোচ্ছি আর মহলটাও আস্তে আস্তে বড় মনে হচ্ছে। দিনের আলোয় ধবধবে সাদা মহল যেন সুগৌরবে মহীয়ান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সামনে যেতেই দেখলাম এক পাশে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের এক বিশাল মূর্তি প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তা ছাড়া অন্য আরেক পাশে ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের মূর্তি।
১৯০১ সালে তাঁর তত্ত্বাবধানে এই প্রাসাদ তৈরি করা হয়। ইনি ত্রিপুরার সর্বশেষ রাজার আগের রাজা। সর্বশেষ রাজা ছিলেন মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদূর। প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে বুঝলাম এর বিশালতা। যেমন সুউচ্চ এটি, তেমন এর বিস্তৃতি। এই প্রাসাদের তত্ত্বাবধানে অনেক কর্মী নিয়োজিত আছেন। প্রাসাদের প্রধান সিঁড়ির দুপাশে আলোকবর্তিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে দুই নারী মূর্তি। রাজার প্রাসাদ বলে কথা! যদিও প্রধান সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নিষেধ ছিল। নিচ থেকেই যাওয়ার পথ। প্রাসাদে ঢুকতেই গার্ড বসা। টিকিট দেখে বলল, ছবি তোলা নিষেধ। ফোনটা পকেটে রেখে, ঢুকে পড়লাম।
প্রাসাদের ভেতরটা এখন জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সবকিছুই অত্যন্ত সুন্দর করে সাজানো। কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া, এমনকি ফোনে ছবি তোলাও নিষেধ ছিল। একটা প্রশ্ন মাথায় থেকেই গেল। ছবি যদি তুলতে না–ই দেয়, তাহলে ক্যামেরার জন্য ৬০০ টাকা লেখা ছিল কেন?
ত্রিপুরার ইতিহাস, সংস্কৃতি, স্থানীয় মানুষদের ব্যবহৃত পোশাক, কাপড় উৎপাদনের যন্ত্র, রেশম গুটি, রেশম কাপড়, বিভিন্ন জাতির মানুষের গয়না, ব্যবহৃত অস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র, ঘরবাড়ির নকশা, বিভিন্ন কষ্টিপাথরের মূর্তি, মন্দির মসজিদের মিনিয়েচার, লোকাল ম্যাপ, ফসিল, জীবজন্তুসহ এককথায় বিচিত্র সব জিনিসের সমারোহ দেখা গেল এখানে। মন দিয়ে দেখলে ত্রিপুরার ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশ ভালোই জ্ঞান লাভ হয়ে যাবে। তা ছাড়া রাজাদের ব্যবহৃত সব তৈজসপত্র, পোশাক থেকে শুরু করে তাঁদের সে সময়ের চিত্রকর্মসহ এসব কিছুই অবাক করে দিয়েছিল আমাদের। অত বড় প্যালেসের পুরোটাই জাদুঘরের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
আরেকটা জায়গায় আটকে গেলাম। বাংলাদেশের যুদ্ধের সময়ে ব্যবহৃত ক্যামেরা, কিছু অস্ত্র, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকসহ নানা পত্রিকার সমাহার দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই জানি। এখানে রাখা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কিছু ছবি সত্যিই বিস্ময়কর। এই ছবিগুলো না তুললে হয়তো অনেক কিছুই অস্পষ্ট থেকে যেত। যুদ্ধ চলাকালীন কিছু মুহূর্ত, বিজয়ের পরের উল্লাসের মতো ছবি সত্যিই মুগ্ধ করল। তা ছাড়া যুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ ত্রিপুরায় এসেছিলেন। সে ছবিও প্রদর্শিত আছে এখানে। বেশির ভাগ ছবি তুলেছিলেন প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার রবিন সেনগুপ্ত। তিনি তখন ত্রিপুরায় ফটোসাংবাদিক ছিলেন। তাঁর ব্যবহৃত ক্যামেরা সেখানে প্রদর্শিত রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন এ জন্য।
প্রধান দরজার সামনেই একটা বিশাল কামান রাখা। ওপাশে একখানা টেবিলে খাতায় আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে মতামত লিখতে বলা হলো। লেখা শেষ করে প্রধান ফটক থেকে বেরিয়ে এলাম। প্রায় ২৫০ একরজুড়ে এই প্রাসাদ। যদিও বা এখনো প্রাসাদের কিছু সংস্কারের কাজ চলছে। প্রাসাদের একদম দক্ষিণ দিকে রয়েছে রেস্তোরাঁ। সেখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম।
এরপর শহরের কিছু জায়গা যেমন, রেলস্টেশন আর বাজার ঘুরে কিছু টুকটাক কেনাকাটা করলাম। বিকেল পার হয়ে সন্ধ্যা নামতেই হোটেলে ফিরে আসা হলো। সেদিনের মতন ঘোরাঘুরির ইতি টানলাম এখানেই।