একপাশে পদ্মফুলের বাহার, অন্যপাশটায় শাপলা বন। মাঝখানে একটু খোলা জায়গা। ওই জায়গার জল বেশ পরিষ্কার। বেজায় শীত পড়েছে। সূর্য উঠেছে একটু আগে। তবু একটি পাখি ওখানে টুপটুপ ডুব দিচ্ছে। পাশেই হোগলাবনের সারি। হোগলাবনের পাশে চুপচাপ ভেসে থেকে দুটি ছানা বাবার টুপটুপ ডুব দেখছে। বাবা জলের তলা থেকে ভুস করে ভেসে উঠলেই ওরা গাল হাঁ করে তুলছে খিদের কান্না। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, খুব খিদে পেয়েছে ছানা দুটির। অন্য একটি ছানা বেশ আরাম করে চড়ে বসেছে মায়ের কোলে (পিঠে), মা খাবার খুঁজছে পদ্মবনের ফাঁকে ফাঁকে। পিঠে বসে ছানাটি খুব মনোযোগ দিয়ে মায়ের কাজকর্ম দেখছে।
বাবা-পাখিটি একটি ছোট মাছ ঠোঁটে চেপে যেই না ভেসে উঠল ভুস করে—ভাসমান ছানা দুটি কার আগে কে যাবে—এভাবে ছুটল ওপর দিয়ে। বাবা অবশ্য লম্বা ঘাড়টা উঁচু করে ছানা দুটিকে পরখ করল আগে, তারপর তার সামনেই সদ্যমৃত মাছটি ভাসিয়ে দিল—যাকে সে বেশি ক্ষুধার্ত বলে মনে করল। যে মাছটি পেল না, সে অন্য ছানাটিকে আলতো একটা ঠোকর মারল। বাবা আবার ডুব দিল।
তিনটি ছানারই বয়স এক মাসের কম। সুন্দর ডাসা ডাসা চোখ। মাথা ও ঘাড়ে কয়েকটা করে ডোরাকাটা দাগ। যেভাবে ভাসছে, তাতে মনে হয় বালিহাঁসের ছানা। কিন্তু ওদের ঠোঁট হাঁসের ঠোঁটের মতো নয়। সরু ও লম্বা ধরনের ঠোঁট। লেজ নেই। লেজ অবশ্য ওদের মা-বাবারও নেই। কিন্তু ছানাদের মতো মা-বাবার শরীরে ডোরাকাটা দাগ নেই। একদিন ছিল, যখন তারাও ছিল কম বয়সী। এই ছানা তিনটি যখন বড় হবে, তখন মিলিয়ে যাবে শরীরের ডোরাকাটা দাগগুলো। এখনকার মতো মিষ্টি মিষ্টি সুন্দর চেহারা আর থাকবে না ওদের।
বাবা পাখিটি বোধ হয় হাঁফিয়ে গেছে। তাই আর ডুব দিচ্ছে না। শীতও বোধহয় লেগে গেছে খুব। রোদপিঠ হয়ে তাই ভাসছে চুপচাপ। ছানা দুটি তখন এগিয়েই চড়ে বসল বাবার পিঠে। ক্লান্ত বাবা একটু বাদেই ছানা দুটিকে পিঠ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল। ঠিক তখনি আকাশের অনেক ওপর থেকে ডাইভ মারল একটি মেছো-ঈগল। ওর ডানার ছায়া দেখার সঙ্গে সঙ্গেই জলের ওপরে ডানার শব্দ তুলে প্রথমে ডুব দিল বাবা-পাখিটি, পরমুহূর্তেই ছানা দুটিও জলের তলায় অদৃশ্য। পদ্মবনে থাকা মা পাখিটিও ডুব দিয়েছে, পিঠের ছানাটিও তাই। অতএব ডাইভ মিস করল মেছো-ঈগল, তাই বলে চলে গেল না। জলের বেশ ওপরে উঠে পাক খেতে লাগল। আড়াই মিনিট পরে একটি ছানা যেই না ভেসে উঠল ভুস করে, অমনি জঙ্গি বিমানের মতো ডাইভ মেরে ছানাটিকে নখরে গাঁথল মেছো-ঈগল, বেশ খোশ মেজাজে উড়ে চলল বিলের কিনারার দিকে। বেশ মজা করে সকালবেলার নাস্তাটা সে সেরে নেবে কোনো গাছে বসে। নখরে গাঁথা তুলতুলে ছানাটা ছটফট করছে, কাঁদছে। দু-একটা করে পালক খসে পড়ছে। এই বিপদে সে পড়েছে নিজের বোকামির জন্য। ডুব দিয়ে যদি সে জলের তলা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে মাথা ভাসাত শাপলা-পদ্মের ফাঁকে, তাকে ধরতে পারত না ঈগলটি। অন্য ছানাটি তা-ই করেছে, মাথা তুলেছে গিয়ে হোগলাবনের ফাঁকে। আর যে ছানাটি ছিল মায়ের সঙ্গে, সে ছিল তিন ভাই-বোনের ভেতর ছোট। ডুব দিয়ে সে জলের তলায় বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি বটে, পদ্মপাতার তলায় মাথা গুঁজে পড়েছিল চুপচাপ।
ঈগলটি চলে যাবার পর মা-বাবা একত্র হলো। দুটি ছানাকে নিয়ে ঢুকে পড়ল হোগলাবনের ভেতর। একটি ছানা গেছে। এই দুটিকে তারা হারাতে চায় না। কবে যে বাচ্চারা বড় হবে, বুদ্ধিসুদ্ধি হবে, নিজেদের বাঁচাতে শিখবে শত্রুর হাত থেকে! কতই-না বিপদ এই বিলে। বন্দুকের গুলি খেয়ে সরালি হাঁসেরা মরে। ফাঁদে পড়ে কালিম পাখিরা। জলপিপিরা ভয়ে এই বিল ছেড়ে গেছে। প্রতিদিনই জল কমছে মাঘের মাঝামাঝি সময়ে। ছানা দুটি যখন স্বাবলম্বী হবে, উড়তে শিখবে ভালো করে, তখন এই বিল ছেড়ে তারা চলে যাবে অন্য বিলে। আবার ফিরে আসবে বর্ষাকালে। বর্ষাকালে এই বিল নিরাপদ। নিশ্চিন্তে বাসা করা যায়। ডিমে তা দেওয়া যায়। এই যে ছানা দুটি—বেঁচে থাকলে ওরাও আগামী বর্ষায় ফিরবে আবার এই বিলে। বাসা বাঁধবে, ডিম পাড়বে।
এই পাখিগুলোর নাম হচ্ছে ডুবুরি। সার্থক নাম। ডুব-সাঁতারে দারুণ পটু। জলের ওপরে কোনো কম্পন না তুলেও ডুব দিতে পারে ভুস করে। জলের তলায় ডুব দিয়ে কমপক্ষে থাকতে পারে ৩ মিনিট। বিপদে পড়লে আরও বেশি। জলের তলা দিয়ে এরা স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে সাঁতার কেটে সামনে এগোতে পারে। ও রকম অবস্থায় দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারা যাবে না, মনে হবে যে একটি সামুদ্রিক কচ্ছপ এগিয়ে যাচ্ছে। এই পাখিদের পা যেন পেছন দিকে সেট করা, ওই পা দিয়ে ওরা জল ঠেলতে পারে চমৎকারভাবে। কিন্তু মাটিতে ওরা ভালোভাবে হাঁটতে পারে না। ওদের ডানা খুব ছোট, তাই সহজে উড়তেও চায় না; তাই বলে প্রয়োজনের সময় যে উড়তে পারে না, তা কিন্তু নয়। বেশ উড়তে পারে।
পরিষ্কার জলের তলায় ওরা পরিষ্কার দেখতে পায় সব কিছু। আবার রাতেও বেশ চোখে দেখে। লেজ না থাকায় এদের শরীরের গড়নটা চমৎকার লাগে। একটা পাকা তালের আঁটিকে মাটিতে শুইয়ে রাখলে এদেরকে তালের আঁটি বলেও মনে হবে। ঠোঁট-ঘাড় লম্বা। তবু দূর থেকে হাঁস বলেই মনে হয়। তাই এদের আরেক নাম ডুবুরি-হাঁস। পানডুবিও বলা হয়। মেয়ে ও পুরুষ পাখি দেখতে একরকম। তবে যখন বাসা করে, তখন থাকে দারুণ খুশি। তাই বুঝি তখন ওদের শরীরের রং খোলে। ওদের মাথা, ঘাড় ও গলার পালকের রং তখন হয় গাঢ়-বাদামি, তাতে যেন একটু লালচে আভাও থাকে। এমনিতে ডুবুরিদের রং বাদামি। তাতে যেন মেটে রঙের মিশেল থাকে। পেট-বুকের পালক খুব মসৃণ, চকচকে, তাতে রূপালি আভা। মোলায়েম পেটে হাত ছোঁয়ালে মনে হবে পাখিটির সারা শরীরই বুঝি পালকে ভরা—মাংস বা হাড় নেই। যখন বাসা করে, তখন এদের চোখের নিচটায়, ঠোঁটের গোড়ায় চৌকো ধরনের হলুদ দাগ ফোটে। অন্য সময় ওই দাগ থাকে না। বাসা করার সময় এদের পিঠের রং হয় বাদামি, অন্য সময় ম্লান হয়ে যায়। ডুবুরিদের ঠোঁট বেশ চোখা ও ধারালো। সুন্দর চোখ। সহজে ডাকে না। কণ্ঠস্বর ‘হুইট হুইট হুইটি’ ধরনের। বেশ মিষ্টি গলা। অনেক দূর থেকেও শোনা যায়।
পৃথিবীতে ২১ রকম ডুবুরি আছে। সবচেয়ে বড়টির নাম ঝুঁটি-ডুবুরি (৪৮ সেন্টিমিটার)। আর সবচেয়ে ছোটটি ছোট ডুবুরি (২৬ সেন্টিমিটার)। ছোটটিই বাংলাদেশে আছে, ওর কথাই এতক্ষণ বলা হয়েছে। সৌন্দর্য বিচারে আমাদের ছোট ডুবুরি পৃথিবীর অন্যান্য ডুবুরির চেয়ে কম যায় না। লাল-ঘাড় ডুবুরি ও কালো-ঘাড় ডুবুরি। দুটিই সুন্দর পাখি। ওরা অবশ্য আমাদের দেশে নেই। খোপা-ডুবুরি বাংলাদেশে আছে।
বাংলাদেশে এক সময় প্রচুর বিল-ঝিল-খাল-হাওর-বাওড় ও জলাশয় ছিল, সেই সঙ্গে অসংখ্য ডুবুরি। এখন আর তেমন নেই। ওরা খুব ভীতু পাখি। তাই তো খুব সাবধানে থাকে, খায় জলজ উদ্ভিদের কচি পাতাসহ ছোট ছোট মাছ, শামুক, গুলি, ব্যাঙাচি ইত্যাদি।
ওরা বর্ষাকালে এবং শরতের শেষেও বাসা করে। দুজনে মিলে বাসা করার জায়গা নির্বাচনে সময় লাগায় ২-৩ দিন। বানায় ভাসমান বাসা। জলজ উদ্ভিদ-গুল্মের ওপরে জলজ ঘাস ও গুল্মের নরম ডগা দিয়েই বেশ বড়সড় বাসা বাঁধে। বাসার ওপরে শাপলা-পদ্ম বা শোলা গাছের ডালপাতা থাকে। আকাশ থেকে তাই শিকারি পাখিরা বাসা দেখতে পায় না। কচুরিপানার ভেতরেও বাসা করে। প্রয়োজন পড়লে ও সম্ভব হলে ওরা বাসা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে পারে। দুজনে মিলে ঠোঁটে টেনে টেনে সরায় ভাসমান বাসা।
দুজনে মিলেই বাসা করে ৩-৬ দিনে। তারপর মেয়ে-পাখিটি চারটি ডিম পাড়ে, ডিমের রং মেটে-সাদা। দুজনে পালা করে ডিমে তা দেয়। তবে রাতে মেয়ে-পাখিই ডিমে বসে থাকে। ডিম ফোটে ২৭-৩০ দিনে। বাচ্চারা উড়তে শেখে ২৮ দিন পর। অবশ্য বাসা ছাড়ে খুব তাড়াতাড়ি—লাফিয়ে নামে জলে। মা-বাবার পেছনে পেছনে ঘোরে, পিঠেও চড়ে। ডুবুরিদের ডানা ছোট হলেও দুডানার তলে দুটি ছানাকে লুকিয়ে রাখতে পারে বেশ। ওই অবস্থায় ডুব দিয়ে জলের তলায় সাঁতারও কাটতে পারে অনেকটা দূর।
ডুবুরিরা নিজেদের পালক নিজেরাই খায়। বাচ্চারা ঠুকরে ঠুকরে খায় মা-বাবার বুক-পেটের কোমল পালক। কী জানি, পালকে কোনো ঔষধি গুণ আছে কি না। ডুবুরিরা আরও একটা ভিন্নধর্মী কাজ করে, আর তা হচ্ছে, বাসা থেকে যাওয়ার সময় প্রতিবারই ডিমগুলো ঢেকে রেখে যায় জলজ উদ্ভিদ-গুল্মের পাতা দিয়ে। বাসায় ফিরে আবার ওগুলো সরায়, তারপর ডিমে বসে। ছানারা ছোট থাকা অবস্থায়ও এই কাজ করে মাঝেমধ্যে। ভেজা পাতার তলে ছানারা পড়ে থাকে চুপচাপ।
ডুবুরিরা কমে যাচ্ছে আমাদের দেশে। উপকারী ও সুন্দর এই পাখিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, টিকিয়ে রাখার জন্য সবারই কাজ করতে হবে। ওরা বিল-ঝিল-জলাশয়ের উদ্ভিদ-গুল্ম ও ঘাসের স্বাস্থ্য রক্ষায় ও বংশবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জলের ওপরে ভেসে ও ডুব সাঁতারের কৌশল দেখিয়ে প্রকৃতিকে আরও সুন্দর করে। ‘সুন্দর’কে বাঁচিয়ে রাখা খুব জরুরি।