দেশের যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রত্যাশা অনেক কিন্তু প্রাপ্তি যৎসামান্য, বাংলা একাডেমি তেমনই একটি। প্রত্যাশিত বইয়ের অভাব, গবেষণায় অপ্রতুল বরাদ্দ, পুরস্কারে অনিয়ম, বইমেলায় স্টল বরাদ্দ নিয়ে নয়ছয়, নিয়োগে দুর্নীতিসহ বহু সমস্যায় জর্জরিত প্রতিষ্ঠানটি। অনেক জরুরি বই বছরের পর বছর ছাপা হয়নি। তবে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লেখা বইয়ে সয়লাব প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, গবেষণা ও প্রচারের লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে এ একাডেমির প্রতিষ্ঠা। কালক্রমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গবেষকদের ভরসাস্থলে পরিণত হয় বাংলা একাডেমি। তবে আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের সময়কালে প্রতিষ্ঠানটি দলীয় মতাদর্শের প্রচারে মূলত সর্বশক্তি নিয়োগ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলা একাডেমি গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬ হাজার ৪০৫টি বই ও পত্রিকা প্রকাশ করেছে। বর্তমানে এর মধ্যে ১ হাজার ৫৯৭টি বই ও সাতটি পত্রিকা বিক্রয়যোগ্য তালিকায় রয়েছে। তার মানে, চার ভাগের এক ভাগ বইও পাওয়া যায় না।
বাংলা একাডেমির ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ৩৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। তবে গবেষণায় বরাদ্দ মাত্র ২০ লাখ টাকা, অর্থাৎ ০.৫ শতাংশ। মোট বাজেটের বড় অংশ যায় বেতন-ভাতা ও পেনশনে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বইয়ের বন্যা
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে বই প্রকাশের কথা বাংলা একাডেমির। কিন্তু তারা বিগত সরকারের মতাদর্শের বইয়ে মনোযোগী ছিল। ২০২২-২৩ সালে বাংলা একাডেমি ৬৪টি বই প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ৩৭টি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ হাসিনা ও শেখ রাসেলকে নিয়ে। আর ২০২০-২১ সালে মুজিব শতবর্ষে শতাধিক বিষয়ে অত্যন্ত নিম্নমানের শতাধিক বই প্রকাশ হয়।
সাবেক মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদার সম্পাদনায় গত তিন বছরে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ১৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
এখন বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র রচনাবলি পাওয়া যায় না। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর রচনাবলিও আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি। বাংলা একাডেমির প্রস্তাবক আবুল মনসুর আহমদের রচনাবলির কাজ ১৯৯৮ সালে শুরু হলেও এখনও শেষ হয়নি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচনাবলির সব খণ্ডও পাওয়া যায় না। মেলে না লেখকচরিত অভিধান ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসও। এমন আরও শত শত গুরুত্বপূর্ণ বই বছরের পর বছর ধরে ছাপা হয় না। পাঠক-লেখকরা এসব বইয়ের সন্ধানে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসেন।
স্বৈরাচারের ধারা বহাল
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৫ সেপ্টেম্বর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটিতে দেড় দশকে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্মরণসভায় একাডেমির উপপরিচালক ড. সাইমন জাকারিয়াকে আলোচক হিসেবে রাখা হয়েছিল। তবে লেখক-সাংবাদিকদের আপত্তির মুখে শেষ মুহূর্তে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর সহযোগী হিসেবে সাইমন জাকারিয়া বাংলা একাডেমিতে দীর্ঘদিন প্রভাব নিয়ে চলেছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরও সেই প্রভাব বহাল রয়েছে।
এদিকে গণঅভ্যুত্থানের প্রায় আড়াই মাস পর একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আওয়ামী ঘরানার কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত সেলিনা হোসেনকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিন বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছিল সরকার।
চাকরিরতদের পুরস্কার
দেশের সাহিত্য অঙ্গনের সবচেয়ে বড় পুরস্কারটিও যথেষ্ট কলুষিত হয়েছে। খোদ বাংলা একাডেমিতেই চাকরিরত অবস্থায় তিন লেখক পুরস্কার বাগিয়ে নিয়েছেন। এ নিয়ে লেখকরা তীব্র সমালোচনা করেছেন।
একাডেমির সদ্য সাবেক পরিচালক ড. আমিনুর রহমান সুলতান ২০২১ সালে অনুবাদে, ২০২৩ সালে ফোকলোরের পরিচালক ড. তপন কুমার বাগচী এবং ২০১৯ সালে উপপরিচালক ড. সাইমন জাকারিয়া বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন।
আমিনুর রহমান সুলতান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপকমিটির সদস্য ছিলেন আর অন্যের সম্পাদিত লোকসাহিত্যবিষয়ক বই থেকে হুবহু লেখা চুরি করে নিজের নামে প্রকাশ করার অভিযোগে ড. তপন বাগচীর বাংলা একাডেমি পুরস্কার বাতিলের দাবি উঠেছিল।
সাবেক মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদার সময় নবম থেকে ২০ গ্রেড পর্যন্ত বিভিন্ন পদে ১৮০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের অনেকে টাকার বিনিময়ে চাকরি পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে নূরুল হুদাকে ফোন করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
এসব বিষয়ে কবি ও দার্শনিক ফরহাদ মজহার সমকালকে বলেন, একদম পরিষ্কার কথা হচ্ছে আওয়ামী আমলে নিয়োগ পাওয়া বাংলা একাডেমির কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করতে হবে। অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁর হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। তিনি মনে করলে ভালো ভালো কাজ করতে প্রয়োজনে জাতীয় পরামর্শক কমিটি করতে পারেন। দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের জাতি গঠনে জরুরি বয়ান তৈরির জন্য ১৯৫২ সালে বাংলা একাডেমি যে ভাবমূর্তি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, একদম সেই চিত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। তৃতীয়ত, বাংলা একাডেমিকে ব্যবসায়ীদের কবল থেকে মুক্ত করতে হবে। বাংলা একাডেমি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশকে গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। বইমেলার প্রকাশকরা আলাদা বইমেলার ব্যবস্থা করতে পারেন। তবে বাংলা একাডেমির একমাত্র কাজ হলো সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল লেখক-সাহিত্যিক ও তাদের কাজকে প্রমোট করা। চতুর্থত, আওয়ামী আমল এবং তার আগেও যেসব অযোগ্য লোকজনকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাতিল করতে হবে।
বইমেলায় স্টল বরাদ্দ নিয়ে নয়ছয়
ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশে বইমেলার আয়োজনের দায়িত্বে থাকে বাংলা একাডেমি। এখানে দায়িত্বহীনতার সর্বোচ্চটা দেখিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আওয়ামী লীগের মতাদর্শের বাইরের কাউকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। আবার নিয়ম ভেঙে মন্ত্রী-এমপি ও সরকারদলীয় প্রভাবশালীদের নামকাওয়াস্তে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পেয়েছে স্টল। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জানিয়েছেন, তাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা দীর্ঘদিন ধরে বইমেলায় স্টল পায়নি কবি ফরহাদ মজহারের সংশ্লিষ্টতার কারণে। অথচ তারা প্রয়োজনীয় সংখ্যক বই প্রকাশ করেছেন।
সম্প্রতি বাংলা একাডেমির সংস্কারে ১৫ দফা প্রস্তাবনাসহ একটি নিবন্ধ লিখেছেন গবেষক ও কবি ইমরান মাহফুজ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, ‘বাংলা একাডেমি অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। এটির যে আলাদা বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র আছে, তা মন্ত্রণালয় ও একাডেমির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণে বোঝা যায় না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র স্বপ্নের এ একাডেমিকে বলা হয় বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক। কিন্তু নিকট-অতীতে তা খুঁজে পাইনি। যেমন– কবি আবদুল কাদির গবেষণা কেন্দ্র চালু করার ১০ বছরেও তাঁকে নিয়ে কোনো কাজ হয়নি।’
ইমরান মাহফুজ বলেন, এখানে দেশীয় ভাষা ও সাহিত্য উন্নয়নে ভূমিকা নেই বললেই চলে। বাংলা একাডেমির বানান স্বয়ং সরকারের প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে না। কিন্তু তা দেখার কেউ নেই।
এসব বিষয়ে বাংলা একাডেমির নতুন মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ আজম সমকালকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি তার সব সক্ষমতা নিয়েই আছে। সরকারি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে যেহেতু অন্যরকম বই বেশি প্রকাশ করতে হয়েছে, ফলে একাডেমির নিয়মিত কাজে খানিকটা ভাটা পড়েছে। এখন আমাদের কাজ হবে গবেষণামূলক বই প্রকাশ বাড়ানো। সেই সক্ষমতা বাংলা একাডেমির আছে। একাডেমির নিয়মিত কাজের সক্ষমতা বেশ ভালো।
বাংলা একাডেমি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন। এ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সমকালকে বলেন, ‘আগে অনেক কিছুই হয়েছে, এখন আর সেভাবে চলবে না। তবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমি নিজের মতো করে তার কাজ করবে।