বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়তে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
সরকারের অগ্রগতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমাদের অগ্রগতি বেশ জোরেশোরেই শুরু হয়েছে৷ এই সরকার যখন যাত্রা শুরু করেছিল তখন প্রশাসনিক বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বলেন, বিচারই বলেন সবক্ষেত্রে যে ধরনের পরিস্থিতি ছিল, সেই পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে সামাল দিয়ে তারপর কাজ শুরু করতে হয়েছে৷ আপনি যদি দেখেন সবক্ষেত্রে বৈষম্যের কথা বলে যে আন্দোলনগুলো হয়েছে, প্রত্যেকটা আন্দোলনের সঙ্গেই সরকার বসেছে৷ প্রত্যেকটা আন্দোলনের কথাই শুনেছে৷ তারপর একটা সিদ্ধান্ত দিয়েছে৷ সরকার যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সেটা যারা আন্দোলন করেছে তারা মেনে নিয়েছে৷ বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে কতগুলো জায়গাতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে৷ বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে, প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে, দুদককে শক্তিশালী করতে হবে, গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করতে হবে, সবচেয়ে বড় কথা হলো জনগণকে ক্ষমতায়িত করতে হবে৷ আমাদের দেশে যে একটা ভিভিআইপি কালচার গড়ে উঠেছিল সেটাকে ভাঙতে হবে৷ এর প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সরকার তার কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে৷ কোথায় কোথায় সংস্কার করলে আমরা বৈষম্যমুক্ত সমাজ পাবো, ভিভিআইপি সংস্কৃতি ভাঙতে পারবো সেই কাজগুলো হচ্ছে৷ প্রশ্নের শেষ উত্তরে আমি বলব, কদিন আগেই যদি আপনি দেখেন আমাদের যিনি সরকারপ্রধান তিনি এয়ারপোর্টে প্রবাসী শ্রমিক ভাই-বোনদের জন্য আলাদা একটা লাউঞ্জ করেছেন৷ এ যাবৎকাল আমরা ভিআইপি ও ভিভিআইপি কাউন্টার দেখেছি৷ এখন থেকে সেখানে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য আলাদা কাউন্টার দেখা যাবে৷ ফলে যাত্রাটা শুরু হয়েছে৷’
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে হতাহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের রক্তের উপরতো এই সরকার প্রতিষ্ঠিত বললেন, যারা আন্দোলন করেছেন তাদের সঙ্গে যারা আন্দোলনে ছিলেন তারাও এই সরকারের অংশ৷ তারাও প্রতিনিয়ত বিক্ষোভ, দাবি সামাল দিচ্ছেন৷ আমরাও কিন্তু এই আন্দোলনে রাজপথে ছিলাম৷ ফলে আমাদের এটা অন্য কারও কাছ থেকে জানতে হবে না যে, কতটা রক্ত মানুষ ঝরিয়েছে৷ ওইটা সম্পূর্ণ সম্মান আমরা করি৷ আর সেটাকে ধারণ করি বলেই প্রথম থেকে আমরা বলে আসছি আমরা আসলে ক্ষমতা না, দায়িত্ব গ্রহণ করেছি৷ অনেকেরই চিকিৎসা হচ্ছে না, এই কথাটা বলা ঠিক না৷ কোনো কোনো জায়গা থেকে এখনওছবি নামানো প্রসঙ্গে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র কথা বললেন উপদেষ্টা অভিযোগ আসছে যে, চিকিৎসা হচ্ছে না৷ কারণ হচ্ছে, অনেকে যোগাযোগটা করতে পারেনি৷ অনেকে ঠিক আন্দোলনের সঙ্গে ছিল বলে আহত হয়েছে তা না৷ হয়ত ওই দিক দিয়ে যাচ্ছিল বলে আহত হয়েছে৷ ওই যোগাযোগটা স্থাপন করতে সময় লেগেছে৷ যখনই আমরা খবর পাচ্ছি বা কোনো সূত্র থেকে জানতে পারছি কেউ আহত হয়েছিল এই আন্দোলনে তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি এমন একটাও দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবেন না৷ তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷ আবার প্রথমদিকে যারা মারা গেছেন তাদের লাশ পোস্টমর্টেম না করেই পরিবার নিয়ে চলে গেছেন৷ ফলে সেখানে সরকারি সিস্টেমে ভেরিফিকেশনে সময় লেগেছে৷ তবে সেটাও চূড়ান্ত হয়ে গেছে৷ আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঢাকায়ও এন্ট্রি হয়েছে ঢাকার বাইরেও এন্ট্রি হয়েছে৷ সেগুলো ভেরিফিকেশনে সময় লাগছে৷ কিন্তু আমাদের নজরে আনা হয়েছে কিন্তু আমরা ব্যবস্থা নেইনি, এমন দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই৷’
নানা ইস্যুতে ছাত্ররা এখনো কেন রাস্তায় এমন বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘রাজপথে যারা দাবি করছেন তারা আলোচনায় বসবেন না, এমন কথা তো বলেন নাই৷ সরকারের সকল সিদ্ধান্তে সকলে একমত হবেন এমন কথা নেই৷ সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কারও যদি আপত্তি থাকে, আমরা আহ্বান করি আমাদের আলোচনার দুয়ার সব সময়ই খোলা৷ রাজপথে যখন কোনো আন্দোলন হয়, তখন সেটা আমরা শুনি এবং ধর্তব্যে নেই, বিবেচনা করি৷ আপনি যদি খেলাল করেন সরকারি চাকরিতে বয়সের যে বিষয়টা, সেখানে বয়স ৩৫ এবং তাদের দাবি ছিল অনেকবার পরীক্ষা দেওয়ার৷ আমরা বললাম, বয়স ৩২ এবং পরীক্ষা দেওয়া যাবে তিনবার৷ এরপর তারা আবার দাবি করল, তিনবার না, চারবার সুযোগ দিতে হবে৷ আমরা কিন্তু তাদের সেই দাবি শুনেছি৷ অনেকেই অনেক রকম দাবি তুলতে পারে, সরকার সবটাই শুনবে এবং সরকারের আলোচনার দুয়ার সবার জন্য খোলা৷’
বঙ্গভবনসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামানোর বিষয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এই সরকার সংবিধানটাকে বাতিল করেনি, অস্বীকার করেনি, স্থগিত করেনি৷ কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের ফলে আসা একটা সরকারকে সংবিধানের প্রত্যেকটা অক্ষর যদি মেনেই চলতে হতো তাহলে তো গণঅভ্যুত্থানটা হতো না, এই সরকারটাও হতো না৷ এখন ডকট্রিন অব নেসেসিটির একটা বিষয় আছে৷ গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খার একটা বিষয় আছে৷ গণঅভ্যুত্থানের মূল্যবোধের একটা বিষয় আছে৷ এখানে ছবি নামানোটা মুখ্য নয়৷ এখানে হচ্ছে, যে জিনিসগুলোকে পুঁজি করে ফ্যাসিজমটা চলেছে সেই জিনিসের বিরুদ্ধে, সেই প্র্যাকটিসের বিরুদ্ধে একটা অবস্থান নেওয়া৷ এটাকে সাংবিধানিক আলোকে দেখার সুযোগ আছে বলে মনে করছি না৷’
সরকার আন্তর্জাতিক কোনো চাপ অনুভব করছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক কোনো চাপ সেই অর্থে অনুভব করছি না৷ বরং আন্তর্জাতিক বড় ক্ষেত্র আমাদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা দেখি, কোনো কোনো উত্তেজনা এখানে হয়ত সৃষ্টিই করা হয়, কোনো ঘটনা সেই অর্থে সাম্প্রদায়িক নয় সেগুলো বিদেশে নানাভাবে প্রচার করা হয়৷ সেক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকতে হচ্ছে৷ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সমাজ আগেও ছিল না, এখনও নেই, ভবিষ্যতেও হবে না৷ আমার জন্মই তো এদেশে, অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশ ছেড়ে চলে যাইনি৷ এদেশেই আছি৷ ফলে মাঝেমধ্যে মনে হয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এই সরকারের যে গ্রহণযোগ্যতা সেটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে একটা সুসংগঠিত প্রচার চালানো হচ্ছে৷ যেটা অপপ্রচারেই সামিল৷ সেখানে আমাদের বাড়তি সময় দিতে হচ্ছে৷ ওই সময়টা যদি আমরা ওদিকে না দিয়ে দেশ গঠনের কাজে, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের কাজে, প্রশাসনের সংস্কারের কাজে, বিচার বিভাগের সংস্কারের কাজে দিতে পারতাম সেটা আমাদের জন্য ভালো হতো৷’