বাংলাদেশ টেলিভিশনের বহুল দর্শকপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিল্প–সাহিত্য, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসহ নানা বিষয়ই তুলে আনা হয় এই অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি রচনা, পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেন হানিফ সংকেত।
‘ইত্যাদি’র এবারের পর্ব ধারণ করা হয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলের রাজবাড়ীতে। বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) সন্ধ্যার পর দৃশ্যধারণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু অনুষ্ঠাস্থলে ভাঙচুর ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে বলে খবর প্রকাশ করে একাধিক গণমাধ্যম।
শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) সকালে এ বিষয়ে একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানের পরিকল্পক, নির্মাতা ও উপস্থাপক হানিফ সংকেত। ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রানীশংকৈল উপজেলায় টংকনাথের রাজবাড়ি নামে একটি জমিদারবাড়িতে দৃশ্যধারণের আয়োজন করা হয়। জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা অনুষ্ঠানের আগে আট হাজার প্রবেশ পাস দেয়া হয়। কিন্তু অনুষ্ঠানস্থলে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত দর্শক উপস্থিত হয়। এ কারণেই অনুষ্ঠানস্থলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি।
নিরাপত্তার দায়িত্বে আর্মি ও পুলিশের উপস্থিতি ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, যখনই আমরা অনুষ্ঠান শুরু করলাম। দর্শক তালি দিলো। যেই আমি মঞ্চে এলাম, শুনলাম, চারদিক থেকে তিন কিলোমিটারের মতো রাস্তা প্যাকড। পাঁচ লাখের অধিক লোক। এত মানুষকে আমি কোথায় বসতে দেব। লোকজন বাঁশের ব্যারিকেড ছিল, তা ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন তো ম্যাচাকার অবস্থা। ওখানে নারী আছেন, শিশু আছে, আছেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। এরপর হাউকাউ শুরু হয়ে গেলো। পুলিশ থামানোর চেষ্টা করছে, আমিও করছি। অস্থির অবস্থা। কেউ চেয়ার–ছোড়াছুড়ি করছে।
হানিফ সংকেত বলেন, অনুষ্ঠানস্থলের এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় প্রশাসনকে ডেকে বললাম, এভাবে অনুষ্ঠান করা যাবে না। মানুষ শান্ত হোক, তারপর অনুষ্ঠান শুরু করব। আপাতত আমরা অনুষ্ঠান কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখি। অনুষ্ঠানের দৃশ্যধারণ বন্ধ করে দিয়ে লাইট বন্ধ করে জানিয়ে দিলাম, ‘অনুষ্ঠান আপাতত হচ্ছে না। আপনারা শান্ত হন।’ এ–ও অনুরোধ করেছি, ‘চলে যান। পরবর্তী সময় আমরা চিন্তা করব কী করা যায়।’
ঘটনার সূত্রপাত নিয়ে জনপ্রিয় এই উপস্থাপক বলেন, অনুষ্ঠান শুরু সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। সাড়ে সাতটা কি আটটার সময় আমি মঞ্চে উঠার পরই বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এরপর রবি চৌধুরী ও লিজার গানের অর্ধেক হওয়ার পর সেকেন্ড বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এক থেকে দেড় ঘণ্টা অনুষ্ঠানের দৃশ্যধারণ বন্ধ রেখে রাত সাড়ে ৯টার পর আবার শুরু হয়ে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত শুটিং করেছি।
স্থানীয়দের সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানকার স্থানীয় লোকজন খুবই আন্তরিক। তারা এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। লজ্জিত হয়েছেন। আসলে সেখানে আমরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে গেছি। আমরাও বুঝিনি যে এত লোক হবে। কর্তৃপক্ষও বোঝেনি যে এত লোক হবে। আমাদের জায়গাটা আসলে আরো বড় হওয়া উচিত ছিল।
তিনি বলেন, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও অনেকে কাজ করেছে। ছাত্রদলের লোকজনও দেখলাম। এর বাইরে বিভিন্ন দলের লোক এসে সামাল দিল দেখলাম। দর্শকের কোনো অপরাধ আমি বলব না। এখন কেউ যদি আমাকে ভালেবাসে, তা তো অন্যায় নয়। সেই ভালোবাসা থেকে তারা এসেছে। এরপর বসতে না–পারায়, অনুষ্ঠান দেখতে না–পারায়, তাদের খারাপ লেগেছে। কে কার চেয়ে এগিয়ে বসে, এটার প্রতিযোগিতা করছিল। যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল, তা এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে থেমে গেছে। আমরাও চমৎকারভাবে অনুষ্ঠান করেছি।
হানিফ সংকেত বলেন, এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এখানে কিন্তু কোনো ঝগড়া নেই, মারামারি নেই। হামলা নেই। সবাই পরে খুব দুঃখ প্রকাশ করেছে। তারা এ–ও বলেছে, ‘আপনাদের ভালোবাসে, এটা তো অন্যায় না। ভালোবাসি বলেই এই ঘটনা ঘটেছে।’ এখানে কেউই মারামারি করতে আসেনি, হামলাও করতে আসেনি। এখানে এসেছিল উৎসুক জনতা। তারা এসেছে ‘ইত্যাদি’ দেখবে, আমাদের দেখবে, ‘ইত্যাদি’র শুটিং দেখবে বলে।
এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা আগেও হয়েছে জানিয়ে হানিফ সংকেত বলেন, এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা ময়মনসিংহের ত্রিশালে ঘটেছে। ওখানেও কয়েক লাখ লোক হয়েছিল। এরপর তো ছাদ ভাঙার উপক্রম হয়েছিল। তেঁতুলিয়ায়ও যখন শুটিং করেছি, তখন ছাদ ভেঙে পড়ে গিয়েছিল। এমন ঘটনা আমার জীবনে নতুন নয়। তবে আমরা এত কিছুর মধ্যে অনুষ্ঠান একেবারের জন্যও বন্ধ করিনি। এবার যে এক থেকে দেড় ঘণ্টা স্থগিত করেছি, এ রকম হয়নি। হট্টগোল হয়েছে, চালিয়ে গেছি।
তিনি বলেন, অনেক নারী দর্শক ছিলেন। শিশুরা ছিল। তাদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়। তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি অনুষ্ঠান বন্ধ রেখেছিলাম। সবাইকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করেছি, তারা শুনেছেনও। এত লোক, ভয়ে কেউ কেউ কান্নাকাটি শুরু করেছিল। আমরা তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠান বন্ধ করে অনেক দর্শককে স্টেজের পেছনে নিয়ে আসি। তাদের অভয় দিই। অনেক লোক চলে গেলো। সরকারি, বেসরকারি, রাজনৈতিক দলের লোকজনও ছিল অনুষ্ঠানে।
মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশ নিয়ে তিনি আরো বলেন, আমার খুব খারাপ লেগেছে, আমাদের সো কলড কিছু মিডিয়া ইউটিউব, ফেসবুকে এবং প্রথম সারির কয়েকটি মিডিয়া এমনভাবে খবর প্রকাশ করেছে, মনে হয়েছে এখানে হামলা হয়েছে, এই হয়েছে, সেই হয়েছে, মারামারি হয়েছে। কিন্তু কোনো মারামারি হয়নি। চেয়ার মানুষের পায়ে লাগছিল, মানুষ সরিয়ে দিচ্ছিল, এই যা। এগুলো তো অন্য জিনিস। আমার কাছে ন্যুইসেন্স (উপদ্রব) মনে হয়নি। হুলুস্থুল হয়েছে, হুড়োহুড়ি হয়েছে, বিশৃঙ্খলা হয়েছে।