ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে নয়, বরং সরকারকে খরচ কমিয়ে, বিকল্প উপায়ে রাজস্ব বাড়িয়ে বর্তমান বাজেট ঘাটতির সমাধান করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, কর বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানোর মতো সহজ রাস্তায় হেঁটে সরকার দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তুলবে। তিনি জনগণের ওপর পরোক্ষ কর আরোপের মতো অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহার করার আহ্বান জানান।
আজ শনিবার দুপুরে গুলশানের বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ আহ্বান জানান। এ সময় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির মহাসচিব মনে করেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রাজস্ব সংগ্রহের জন্য বিকল্প উপায় বিবেচনায় নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তিনি দলের পক্ষ থেকে এ রকম অন্তত ১৫টি উপায় সরকারের বিবেচনার জন্য তুলে ধরেন।
‘আমরা বুঝতে পারছি, তবু উদ্বিগ্ন’
মির্জা ফখরুল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার চলমান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যেই ১০০টির বেশি পণ্যের ওপর ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক আরোপ করেছে। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, ওষুধ এবং মোবাইল ইন্টারনেট সেবার কর অব্যাহতি তুলে নিয়েছে।
বিএনপি নেতা বলেন, সরকারের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তারা চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতির প্রথম ধাপের ৪২ হাজার কোটি টাকা ও পরবর্তী সম্ভাব্য ঘাটতি এবং বিভিন্ন শর্ত পূরণ করে আইএমএফের ঋণের জন্য এই ভ্যাট বাড়িয়েছে। কারণ, বর্তমান রাজস্ব দিয়ে সরকার বাজেটের খরচ মেটাতে পারছে না। কিছুদিন আগে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু লুণ্ঠিত ব্যাংকের তারল্য সংকট মেটাতে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েছে। যদিও সরকার তার মেয়াদের শুরুতে বলেছিল, দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবস্থাতেই টাকা ছাপানো হবে না।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পরবর্তী সময়ে আর্থিক খাতেও ভঙ্গুর অবস্থা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। তবু বিএনপি শতাধিক পণ্যের ওপর ‘ভ্যাট ও শুল্ক’ আরোপের সিদ্ধান্তে সাধারণ জনগণের জীবনের ওপর প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। দেশের শাসনব্যবস্থায় যেই থাকুক না কেন, তাকেই সেই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে এবং যোগ্যতা ও সাহসের সঙ্গে তা মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এই চ্যালেঞ্জগুলো কার্যকর উপায়ে মোকাবিলা না করে অর্থবছরের মাঝপথে হঠাৎ করে ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধি করল। এমন সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে, বিশেষ করে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবে।’
সরকার নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একদিকে নীতি সুদহার বাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে, মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। এমন সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ীসহ আর্থিক খাত–সংশ্লিষ্ট মহলে তীব্র অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। এই সিদ্ধান্তকে অর্থনীতিবিদেরা সরকারের মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের চরম ঘাটতির প্রমাণ বলছেন।
অর্থনৈতিক ভঙ্গুর অবস্থায় সহজ রাস্তায় হেঁটে ভাটের হার তথা কর বাড়িয়ে সরকারের খরচ মেটানোর চেষ্টা করলে তা জনগণের জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর হবে না।
সরকারি খরচ কমান, উন্নয়ন বাজেট পুনর্বিবেচনা করুন
কর না বাড়িয়ে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর দিকে মনযোগ দিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, পরোক্ষ কর সব শ্রেণির মানুষকে প্রায় সমানভাবে প্রভাবিত করে। আবার প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়েও সরকারি খরচ কমিয়ে এবং চলতি বাজেটে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা পুনর্বিন্যাস করে চলমান আর্থিক সমস্যার সমাধান করা যায়। তাই, সরকারের প্রথম নজর দেওয়া উচিত খরচ কমানোর দিকে।
উন্নয়ন বাজেট পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা মনে করি, সরকার উন্নয়ন বাজেট পুনর্বিবেচনা করে অপ্রয়োজনীয় ও আর্থিকভাবে অযৌক্তিক প্রকল্পগুলো বাদ দিয়ে প্রায় ২০ শতাংশ খরচ কমাতে পারে। এতে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকার যদি স্থানীয় সরকারের বাজেট এবং ভর্তুকি খাতে খরচ কমায় এবং সার্বিক পরিচালন ব্যয় ১০ শতাংশ কমাতে পারে, তাহলে ন্যূনতম ৫০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব।’
এ প্রসঙ্গে সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, সরকার স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ঋণের বাজেট কমিয়েও সাময়িকভাবে ব্যয় সাশ্রয় করতে পারে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৫০ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা ঋণ বাজেট করা হয়েছিল। অথচ সরকার খরচ কমানোর মাধ্যমে বাজেটের ন্যূনতম এক লাখ কোটি টাকা সাশ্রয় এবং ঘাটতি কমাতে পারে। এই পদক্ষেপগুলো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের স্বার্থে অত্যন্ত জরুরি।
অপ্রয়োজনীয় ও দুর্নীতিগ্রস্ত মেগা প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থ আপাতত বন্ধ রেখেও বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব বলে মনে করেন বিএনপির এই নেতা।
কর ফাঁকি রোধ করুন, পাচারের অর্থ ফেরত আনুন
রাজস্ব আয় বাড়াতে টিআইএনধারীদের রিটার্ন সাবমিট এবং কর আদায় নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, করযোগ্য আয়কে করের আওতায় আনা সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ হতে পারে। কর ফাঁকি রোধ করতে হবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কর ফাঁকির কারণে বছরে ৫৬ হাজার কোটি থেকে সর্বোচ্চ তিন লাখ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আয় কম হয়। এ ছাড়া দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের যেসব সম্পদ জব্দ করা হয়েছে বা অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করা হয়েছে, আইনানুগ পন্থায় সেই অর্থ ব্যবহার করা সরকারের জন্য একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে।
এই মুহূর্তে কালোটাকা উদ্ধারের সরকারি প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের লুণ্ঠিত টাকা এবং নন–পারফরম্যান্স লোনের টাকা উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হবে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। সরকারের শ্বেতপত্র অনুযায়ী, দুর্নীতি ও লুটপাটের প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা উদ্ধার করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা এখন খুব জরুরি। আইএমএফ থেকে ঋণ পেতে সরকার কঠিন শর্তগুলো শিথিল করতে বলতে পারে। এ ছাড়া দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর ঘোষিত অনুদান বা ঋণের অর্থ ছাড় করানোর ক্ষেত্রেও সরকারকে আরও তৎপর হতে হবে। বিগত সরকার বৃহৎ ঋণ খেলাপিদের নানা অনৈতিক সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণের বোঝা বৃদ্ধি করেছে। সরকারের উচিত এসব ঋণ খেলাপি অলিগার্কদের অপরিশোধিত ঋণ পরিশোধে এবং বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে বাধ্য করা।
নতুন উৎস ও উপায় বের করুন
মির্জা ফখরুল বলেন, এভাবে খরচ কমানোর পাশাপাশি সরকার এমন কিছু উৎস ও উপায় খুঁজে বের করতে পারে, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর অর্থনৈতিক চাপ ফেলবে না। যেমন প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্ল্যাবে ইনকাম ট্যাক্সের হার বৃদ্ধি এবং সারচার্জ তথা ওয়েলথ ট্যাক্স বাড়ানোর মাধ্যমে কর আদায়ের ক্ষেত্রে আরও মনোযোগী হওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া নন–ট্যাক্স (নারকটিক্স, লিকার ডিউটি, মোটর ভেহিকল ট্যাক্সেস, নন–জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ইত্যাদি) এবং নন রাজস্ব খাতে (ডে ভিডেন্ট অ্যান্ড প্রফিটস, ইন্টারেস্ট, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ফি, সার্ভিস ফি, ইজারা, টোল ইত্যাদি) আয় বৃদ্ধি করার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। ভ্যাটের হার না বাড়িয়ে ভ্যাটের আওতা বাড়ানো যেতে পারে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তাদের প্রথম উচিত ছিল আওয়ামী লুটপাটের বাজেট বাদ দিয়ে একটা অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট পেশ করা। কিন্তু সেটা না করে ওই লুটপাটের বাজেট বাস্তবায়ন করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুব কঠিন কাজ। আমরা মনে করি, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের যে লুটপাটের বাজেট বাস্তবায়ন থেকে সরে এসে তাদের অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট দিয়ে এগোনো উচিত।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ।