ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় তখন মধ্যরাত। গাজার দক্ষিণ প্রান্তে খান ইউনুস শহরে তখন সবার ঘুমে থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু দেখার জো নেই। অন্য অনেকের সাথে শহরের একটি হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছে কিশোর দাহরান। দাহরান আল দেইফ।
দ্রুম। দ্রিমি দ্রিমি দ্রুম। তারপর আরো বিকট শব্দে বাজ পড়লো যেন। সবাই চমকে যায়। আকাশ কিছুটা আলো করে এই মাত্র হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ইসরাইলি সেনাদের ছোঁড়া একটি রকেট আঘাত হানলো। কি করবে কোনো দিশা না পেয়ে সেখান থেকে বের হয়ে পড়লো দাহরান। কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে। যুদ্ধে হাসপাতালের চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় আর কী হতে পারে? এটা ভেবে রাতে বাড়িঘর ছেড়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল সদ্য ভাই হারা দাহরান। আহত মায়ের সেবা করছিল। ইহুদি হার্মাদগুলোর তাও যেন সহ্য হচ্ছে না। নিজের মনেই বলতে চেষ্টা করে দাহরান।
অক্টোবর ২০২৩। সাত তারিখের ভোর বেলা আচম্বিতে কড় কড় শব্দ করে একের পর এক ইসরাইলি গোলা আর ক্ষেপণাস্ত্র পড়া শুরু হয় গাজায়। খান ইউনুস শহর আর শহরতলিও এর ব্যতিক্রম ছিল না। পড়ি মরি করে যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে বাড়ি আসার পথে গোলার আঘাতে শহীদ হয় দাহরানের বড়ো ভাই, স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র উসমান। উসমান আল দেইফ। ওদের মা হান্নাহ বিনতে হামেদ মুহূর্তে মূর্ছা যান। বাবা তখন পাশে নেই। তিনি এক হাসপাতালের কর্মী। তিনি আরেক প্রান্তে কর্মস্থলে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত। তারপর মা আর এক বোন জান্নাহকে নিয়ে হাসপাতালে আছে দাহরান। না, বড়ো ভাইয়ের জানাজা ও দাফনেও আসতে পারেননি বাবা। হামাসের একটি মারকাজুল ইউনিট এসে লাশ দাফন করেছে। মা সেই সময় থেকে বাক হারা। সারা রাত মায়ের শিয়রে বসে ছিল দাহরান। নামাজ আদায় করে দোয়া করেছে ভাইয়ের মাগফেরাতের জন্য। আম্মু যেন শোক সামলে উঠতে পারে সেজন্য। ফিলিস্তিনিরা প্রতিদিন ছয় ওয়াক্ত নামাজ পড়েও সে দোয়াই করে। ফরজ পাঁচ ওয়াক্তের সাথে যোগ হয়েছে জানাজার নামাজ। প্রতিদিনই কেউ না কেউ শহীদ হচ্ছে। আর তার জানাজা পড়তে হয়। ফলে প্রতিদিন ছয় ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হয়। প্রতি মহল্লায় এই চিত্র।
দাহরান ভাবছিল তারা ফিলিস্তিনিরা কি এমন অপরাধ করেছে যে শুধু মৃত্যুর স্বাদ নিতে হচ্ছে তাদের। তাদের জীবনের কি কোনো দাম নেই? শত্রুরাষ্ট্র ইসরাইল এভাবে হাসপাতালে, বাসা বাড়িতে বিভিন্ন জনসমাগমের স্থানে ইচ্ছাকৃতভাবে বোমা ও রকেট হামলা করে ওদের হত্যা করবে? কেউ কি তা দেখার নেই।
পরক্ষণেই তার মনে হয়, না নেই। কেউ তাদের রক্ষা করার নেই। সবার চোখের সামনে একটা অবৈধ রাষ্ট্র অপরাধ করে চলেছে কেউ তাকে থামাবার নেই।
২.
২০-১০-২৩। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের নির্বিচার বিমান হামলায় ২৪ ঘণ্টায় ৭০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটেছে। গত ৭ অক্টোবর হামাসের সাথে ইসরাইলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর উপত্যকায় ইসরাইলি হামলায় এক দিনে সর্বোচ্চ প্রাণহানির ঘটনা এটি। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। গাজার হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রাতভর ইসরাইলি বিমান হামলায় ৭০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। হামলায় আহত হয়েছেন আরো কয়েকশো মানুষ। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র এমনকি মসজিদেও বিমান হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। ইসরাইল বলেছে, তারা অবরুদ্ধ উপত্যকায় রাতভর হামলায় কয়েক ডজন হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। তবে ইসলামপন্থী এই গোষ্ঠীকে ধ্বংস করতে চলমান যুদ্ধে তাদের দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। হামাসের সাথে যুদ্ধে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন জানাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা ইসরাইল সফর করেছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাঁক্রো ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাথে বৈঠক করেছেন। এ সময় হামাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসরাইলের প্রতি ফ্রান্সের সমর্থন ও সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। বিবৃতিতে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গত ৭ অক্টোবর হামাস-শাসিত এই উপত্যকায় ইসরাইলের বিমান হামলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৭৯১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ২ হাজার ৩৬০ জন শিশু রয়েছে। এর মধ্যে কেবল গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন ৭০৪ জন। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল-কিদরা বলেছেন, ইসরাইলি বিমান হামলা শুরুর পর গত দুই সপ্তাহের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় এটাই ছিল সবচেয়ে বেশি মৃত্যু।
এই পর্যন্ত পড়ে থামে কিশোর দাহরান আল দেইফ। খান ইউনুসের এক টগবগে কিশোর। ভারি চটপটে আর মিশুক। সবার সাথে তার ভাব। রাস্তায়, দোকানে, মসজিদে পাবলিক প্লেসে সবখানেই তাকে আদর করে বড়োরা। বড়োদের সম্মান করে কথা বলে দাহরান। তার মনে অনেক দুঃখ। কেন তারা এই জেলখানায় পচে মরছে। প্রতি দিন পত্রিকা পড়ে সে জানতে পারে অনেক খবর। কিন্তু তাদের দুঃখের অবসান হবে কি না তা লেখা থাকে না। থাকে শুধু বোমা, মৃত্যু আর আগুন জ¦ালানোর খবর। পত্রিকা রেখে সে আশপাশে দৃষ্টি দেয়। কড়া রোদ চারদিকে। আশপাশে কেবল ধ্বংসের চিহ্ন। এতক্ষণ যা পড়ছিল দাহরান, পত্রিকা শিরোনাম দিয়েছে, “২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ৭০৪ ফিলিস্তিনির প্রাণ কাড়লো ইসরাইল”। এখানেও সেই মৃত্যুরই কারবার। মনটা দমে গেল দাহরানের।
খান ইউনুস শহরে খেজুর গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঠিকরে মাটিতে পড়ছে। মাটি মানে ইট সুরকি আবর্জনা ছড়ানো ছিটানো ইসরাইলি বিমান হামলার ড্রেব্রিজ, ধ্বংসাবশেষ। এত মানুষের প্রাণ গেল মনে হয় খেজুর গাছটা তা জানে না। তার পাতা হালকা বাতাসে কাঁপছে। সামনে পেছনে অর্ধভগ্ন ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা খেজুর গাছটা যদি জানতে পারতো তবে কি কান্না করতো? দাহরানের মায়ের মতো, আর সব ফিলিস্তিনি মায়েদের মতো। এই ভাবনা আচ্ছন্ন করে দাহরানকে।
৩.
ফ্লাশ ব্যাক। ৭ অক্টোবর। ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামাসের আকস্মিক হামলার মাধ্যমে শুরু হয় যুদ্ধ। ক্রমাগত মার খেতে খেতে হামাস যোদ্ধারা এক অভিনব পরিকল্পনা করে। তারা বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়ে ইসরাইলের ভেতরে। যেতে যেতে বারো কিলোমিটার পর্যন্ত যায় তারা। না তেমন প্রতিরোধ করতে পারেনি ইসরাইলি সেনারা। করবে কি করে? হামাসের চৌকস যোদ্ধারা এ রকমটা করবে তাদের কল্পনাতেই তা ছিল না।
এই যুদ্ধে ইসরাইলে এখন পর্যন্ত এক হাজার চারশো জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ইসরাইলি সেনার সংখ্যা বারোশো। গতকাল খান ইউনুসের একটি বাজারে মানুষের কাছে এ কথা শুনেছে দাহরান। গর্বে তার বুকটা ভরে গেছে। হামাস যোদ্ধারা সত্যি বাঘের বাচ্চা। পাল্টা হামলায় অনেক বেশি ফিলিস্তিনি শহীদ হচ্ছে। কিন্তু তারপরও এবার যেন মানুষের মধ্যে ভিন্ন একটা চঞ্চলতা দেখা যাচ্ছে। আর তা হচ্ছে শত্রু শিবিরে ঢুকে শত্রু খতম করার একটা আনন্দ। ৭০ বছর ধরে মার খেতে খেতে তারা ক্লান্ত। এখন পাল্টা মার দেওয়ার খবরে তাই চাঞ্চল্য। দাহরানেরও ভালো লাগছে। এবার ইসরাইলের অহংকার চূর্ণ করে দিয়েছে হামাসের বীর সেনারা।
হামাসের আক্রমণে ইসরাইলে নিহতদের কিছু বেসামরিক নাগরিক। এক হামলায় এত সেনা নিহত হওয়ার কথা কোনোদিন ভাবেনি ইসরাইলি সেনারা। তারা এখন মরণ কামড় দেবে এটাই স্বাভাবিক। তবে পরিস্থিতি বুঝে আগাতে হবে সবাইকে। বলছিলেন হামাসের এক কমান্ডার। এদিকে, হামাসের যোদ্ধারা তাদের হাতে জিম্মি দুই ইসরাইলি নারীকে মুক্ত করে দিয়েছে। এ নিয়ে মোট চারজন জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকেই হামাস ২০০ জনের বেশি ইসরাইলি ও বিদেশিকে জিম্মি করেছে। ইসরাইলের অনেক ভেতর থেকে তাদের ধরে এনেছে। লক্ষ্য তাদের বিনিময়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে মুক্ত করা। যারা বছরের পর বছর ধরে আটক আছে ইসরাইলের কারাগারে। অভিযোগ তেমন গুরুতর কিছু নয়। ফিলিস্তিনি হওয়াই অপরাধ এ অপয়া জমিনে। ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি উচ্ছেদ করে তারা বানিয়ে নিয়েছে ইহুদি রাষ্ট্র। একটি অবৈধ রাষ্ট্র। বিশ্বের বহু দেশ আজও এ রাষ্ট্রকে স্বীকার করে না। তারা দখল করে আছে ফিলিস্তিনের পবিত্র শহর জেরুসালেমসহ বিভিন্ন উপকণ্ঠ ও শহর। এখন ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশে পরবাসী। এসব কথা ভেবে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে দাহরানের। অথচ সে কিছুই করতে পারছে না।
১৩ বছরের দাহরান গাজা ভূখণ্ডের খান ইউনুস শহরের একটি বস্তি ঘরের বাসিন্দা। আসলে এটি একটি উদ্বাস্তু শিবির। জেরুসালেমের কাছে নিজ বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে ওর দাদা ৭০ বছরেরও আগে নানা ঘাট পার হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সবাই বলে উদ্বাস্তু শিবির। দাহরানের এই শিবির নামটা ভালো লাগে না। সে বলে আমাদের বাড়িঘর এখানে। আমরা এখানে কেন উদ্বাস্তু হবো? শিবিরে থাকবো?
মাকে বলেছিল একদিন-
: মা, সবাই আমাদের উদ্বাস্তু বলে কেন?
: আহা বাবা। তাতে কী? আমরা তো উদ্বাস্তুই। বিদেশি সাহায্য ছাড়া আমাদের চলেই না। উদ্বাস্তু নয়তো কী সোনা?
এ কথা শুনে রাগ ধরে দাহরানের।
: যাও তোমার সাথে কথা বলবো না। এটা আমাদের দেশ, রামাল্লাহ, গাজা, খান ইউনুস, জেনিন এসব আমাদের এলাকা। ইহুদি দখলদাররা দখল করে নিলো বলে তো তাদের হয়ে গেল না।
: বুঝেছি সোনা। তুমি ঠিক কথা বলেছ। তুমি এক দিন যুদ্ধ করে নিজ বাড়ি আবার তোমার করে নেবে। এবার হলো তো? দুধটুকু এক টানে খেয়ে নাও।
পত্রিকার পাতা থেকে চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকায় দাহরান। এত কষ্টের মাঝেও মায়ের একটু হাসি মুখ দেখলে ভালো লাগে দাহরানের। মা রান্নার আয়োজন করতে কিচেনের দিকে চলে গেলেন এক টুকরো আদর মাখা হাসি দিয়ে। আর ভাবেন আমাদের পাগল ছেলে একটা। কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। ওর স্বভাব হয়েছে ওর বাবার মতো। বাবা আউয়াল আল দেইফ। আগে তেল আবিবে কাজ করতে যেতেন। এখন কাজ বন্ধ। সীমান্ত সীল করে দেওয়া হয়েছে। যাওয়ার সুযোগ নেই। দিনে গিয়ে কাজ শেষে রাতে ফিরে আসতেন। এভাবেই চলছিল। তাও বন্ধ হয়ে গেল। প্রচণ্ড ক্রোধ বাহারের। এখন এখানকার একটি হাসপাতালে কাজ জুটিয়ে নিয়েছেন।
: না এভাবে চলতে পারে না। এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। স্ত্রীকে বললেন কথাগুলো আউয়াল দেইফ।
: কী করবে তুমি একা? আর সবাই না করলে। পাশ থেকে বলেন দাহরানের মা হান্নাহ বিনত হামেদ। তিরিশোর্ধ। মনে হবে পঞ্চাশ হয়েছে বয়স। অভাবে আর চিন্তায় চিন্তায় এ হাল। স্বামীকে নিয়ে তার চিন্তা। পাঁচ ছেলেমেয়েকে নিয়ে, দুটো মেয়ে বড়ো হচ্ছে তাদের নিয়ে তার চিন্তা।
: কিছু করতে না পারলে বোমা মেরে কয়েকটা ইসরাইলি সেনা মেরে মরবো। এই জীবন আর ভালো লাগে না।
: এমনটা ভেবো না। দেখো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
: কিছু ঠিক হবে না। আমেরিকা আমাদের সাথে ভালো ভালো কথা বলে আর ওদের আধুনিক অস্ত্র দেয়। এটা কি ভালো হবার লক্ষণ?
এর কি উত্তর দেবেন হান্নাহ ভেবে পান না।
বাইরে তাকাতে খেজুর বীথির ডাল নড়তে দেখেন হান্নাহ। দাহরানের মতো ওর বাবার সাথেও কথায় পারা যাবে না। একই রকম দু’জন। বাপকা ব্যাটা। মা হান্নাহ ভাবেন।
এদিকে দাহরান ভাবতে থাকে কী করা যায়। তার মনে প্রশ্ন একজন কিশোর কি যোদ্ধা হতে পারে না। দেশের জন্য লড়াই করবে। ফিলিস্তিনের জন্য সংগ্রাম করবে।
তার এক চাচা আছেন লড়াইয়ের ময়দানে। রাইয়ান আদ দেইফ।
কিছু দিন আগে আল কাসসাম ব্রিগেডে নাম লেখান রাইয়ান। অস্ত্র ও যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম তৈরির কাজে একজন কমান্ডারের অধীনে কাজ শুরু করেন তিনি। কয়েক মাস ভালোই চলছিল। একদিন গোলার আঘাতে তিন জন কাসসাম ব্রিগেড সেনার সাথে শহীদ হন রাইয়ান। না রাইয়ানের মৃত্যুতে একটুও কাঁদেনি দাহরান। দাদার মৃত্যু দেখেছে, ভাইয়ের মৃত্যু দেখেছে। খান ইউনুসে কত মৃত্যু সে দেখেছে। কত কাঁদবে সে?
হান্নাহর ভাগ্যটাও ভালো এমন নয়। তিনিও তার দুই ভাইকে হারিয়েছেন। বাবাকে হারিয়েছেন। তিনিই বা কত কাঁদবেন? তার চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে।
শেষে এক ছেলেকে হারালেন। এই শোক আর সহ্য করার নয়। বাক হারা হয়ে এখন শুয়ে আছেন হাসপাতালে।
৪.
গাজা ভূখণ্ড বা গাজা উপত্যকা, আরবিতে বলা হয় কিত্বাউ গাজজাহ। এটি ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত একটি স্ব-শাসিত ফিলিস্তিনি অঞ্চল। অঞ্চলটির প্রায় ৩২০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় রয়েছে চারটি শহর, আটটি ফিলিস্তিনি শরনার্থী শিবির ও এগারোটি গ্রাম। প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি ও ১৭,০০০ হাজার নতুন ইসরায়েলি বসতিস্থাপনকারী এতে বসবাস করে। গাজা ভূখণ্ডের পশ্চিমে রয়েছে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণ-পশ্চিমে মিসর এবং উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে ইসরাইল। যদিও জাতিসংঘে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গাজা ভূখণ্ডের স্বাধীনতা পুরোপুরি স্বীকৃত নয়, এই অঞ্চলটি ফিলিস্তিনি হামাস সরকারের শাসনে রয়েছে। গাজা ভূখণ্ডের পূর্ব সীমান্ত ইসরাইলের দখলে, এবং সিনাই মরুভূমির দক্ষিণ সীমান্ত মিসরের দখলে রয়েছে। ১৯৪৮ সাল হতে ১৯৬৭ পর্যন্ত পুরো ভূখণ্ড মিসরের দখলে ছিল।
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইলি যুদ্ধে ইসরাইল এ ভূখণ্ড দখল করে নেয়, যা এখনও ইসরাইলের দখলে রয়েছে ।
ব্রিটিশ উপনিবেশের পূর্বে গাজা উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। এরপর ব্রিটিশ (১৯১৮-১৯৪৮) ও মিসরীয় শাসন (১৯৪৮-১৯৬৭) শেষে এটি ইসরাইলের অধীনে আসে। ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি অনুসারে ইসরাইল ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষকে স্বীকৃতি দেয়, যারা গাজায় সীমিত পরিসরে স্ব-শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ২০০৭ সাল থেকে অঞ্চলটির শাসনকার্য কার্যত হামাস কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে, যারা নিজেদের ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ ও ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধি দাবি করে।
ফিলিস্তিন ঐতিহাসিক আবর ভূমি। সেখানকার জেরুসালেম শহর ইসলামের পবিত্র স্থান। সেখানকার মসজিদুল আকসা ছিল মুসলমানদের প্রথম কিবলা। কিবলা সেই স্থান মুসলমানরা সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করে। বর্তমানে কিবলা হচ্ছে মক্কা শরীফ। জেরুসালেম খ্রিস্টান ও ইহুদিদেরও পবিত্র স্থান। ফিলিস্তিনকে ইংরেজিতে প্যালেস্টাইন আর আরবিতে ফিলাস্তীন্ বলে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হচ্ছে দাউলাৎ ফিলাস্তীন্। ১৫ নভেম্বর ১৯৮৮ সালে আলজিয়ার্স শহরে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও) ও প্যালেস্টাইন জাতীয় পরিষদ (পিএনসি) একপাক্ষিকভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। ১৯৮৮ সালে ঘোষণার সময়ে কোনো অঞ্চলেই পিএলওর নিয়ন্ত্রণ ছিল না, যদিও তারা যে অঞ্চলগুলো দাবি করেছিল আন্তর্জাতিকভাবে সেইগুলো ইসরাইলের দখলে রয়েছে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ দ্বারা প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন বিভাগ যেভাবে প্রস্তাবিত হয়েছিল, সেখানে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড (গাজা ভূখণ্ড ও পশ্চিম তীর) ছাড়াও ইসরাইল শাসনাধীন কিছু অঞ্চল এবং জেরুসালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দাবি করে তারা।
১৯৭৪ সালে আরব লীগের শীর্ষ বৈঠকে স্থির হয়েছিল যে, পিএলও ফিলিস্তিনের জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি এবং তাদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানিয়েছিল। ২২ নভেম্বর ১৯৭৪ থেকে একটি জাতি হিসেবে পিএলওকে ‘রাষ্ট্রহীন-সত্তা’ রূপে পর্যবেক্ষক অবস্থায় রাখা হয়েছিল। যারা কেবলমাত্র জাতিসংঘে তাদের বক্তব্য রাখতে পারতেন, কিন্তু ভোট দেবার কোনো ক্ষমতা ছিল না।
ভূমধ্যসাগরের পূর্বে ২৮,৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী ফিলিস্তিন দেশটি ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যারা ছিল ব্রিটেন-বিরোধী জোটে। তখন যুদ্ধ জয়ে ফিলিস্তিনদের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর যুদ্ধে জয়ী হলে এই ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন। যা ইতিহাসে “বেলফোর ঘোষণা” হিসেবে পরিচিত। যেহেতু ফিলিস্তিন অঞ্চলে আরবরা ছিল ইহুদিদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি, সেহেতু ঘোষণাটি তাদের অনুকূল বলেই ধরে নেয় স্থানীয় আরবরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান। ফলে আনন্দিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন কী ধরনের পুরস্কার তিনি চান? উত্তর ছিল- “অর্থ নয়, আমার স্বজাতির জন্য এক টুকরো ভূমি আর তা হবে ফিলিস্তিন। ফলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি ইহুদিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয় ব্রিটেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটেন স্বাধীনতা দেওয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে। মূলত এই সময়টিই ফিলিস্তিনকে আরব-শূন্য (বিশেষত মুসলিম-শূন্য) করার জন্য কাজে লাগায় ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি। ১৯২০ সালে জাতিপুঞ্জ ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশরা ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দলে দলে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে জড়ো হতে থাকে, যাকে আলিয়াহ বলা হয়। অতঃপর ব্রিটিশ সরকার একদিকে ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিন উন্মুক্ত করে দেয়, অন্যদিকে ব্রিটিশ বাহিনীর সহযোগিতায় ইহুদি মিলিশিয়ারা (আধা-সামরিক বাহিনী) ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য গড়ে তুলতে থাকে। তারমধ্যে তিনটি প্রধান সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং। যারা হত্যা, সন্ত্রাস, আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বাধ্য করে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যেতে। সংগঠনগুলোর গণহত্যার কথা যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল তখন পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য গুপ্ত সংগঠন হাগানাহ বেছে নেয় আত্মহনন পন্থা। ১৯৪০ সালে এসএস প্যাট্রিয়া নামক একটি জাহাজকে হাইফা বন্দরে তারা উড়িয়ে দিয়ে ২৭৬ জন ইহুদিকে হত্যা করে। ১৯৪২ সালে আরেকটি জাহাজকে উড়িয়ে দিয়ে ৭৬৯ জন ইহুদিকে হত্যা করে। উভয় জাহাজে করে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে আসছিল আর ব্রিটিশরা সামরিক কৌশলগত কারণে জাহাজ দুটিকে ফিলিস্তিনের বন্দরে ভিড়তে দিচ্ছিল না। হাগানাহ এভাবে ইহুদিদের হত্যা করে বিশ্ব জনমতকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করে। পাশাপাশি ইহুদিদের বসতি স্থাপন ও আরবদের উচ্ছেদকরণ চলতে থাকে খুব দ্রুত। এর ফলে ২০ লাখ বসতির মধ্যে বহিরাগত ইহুদির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৪০ হাজার। এ সময়ই ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইঙ্গ-মার্কিন চাপে জাতিসংঘে ভোট গ্রহণ করা হয়, তাতে ৩৩টি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে, ১৩টি বিপক্ষে এবং ১০টি ভোট প্রদানে বিরত থাকে। প্রস্তাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ইহুদিরা পেল ভূমির ৫৭% আর ফিলিস্তিনিরা পেল ৪৩% তবে প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রটির উত্তর-পশ্চিম সীমানা ছিল অনির্ধারিত। ফলে ভবিষ্যতে ইহুদিরা সীমানা বাড়াতে পারে। এভাবে ইহুদিদের কাক্সিক্ষত ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয়ে পড়ে। ফিলিস্তিন অঞ্চলের কার্যত মালিকানা লাভের পর ইহুদি বসতি বাড়ানোর লক্ষ্যে এবং ফিলিস্তিনদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে রাতে তাদের ফোন লাইন, বিদ্যুৎ লাইন কাটা, বাড়িঘরে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, জোর করে জমি দখল এবং বিভিন্নভাবে নারী নির্যাতনের মতো কাজে জড়িয়ে পড়লো স্থানীয় ও বহিরাগত ইহুদি ও সরকারের মদদপুষ্ট সেনাবাহিনী। ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিরা আরব দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপরই ১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২টা এক মিনিটে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করে ইহুদি জায়নবাদীরা, যাদের প্রধান ছিলেন দাভিদ বেন গুরিয়ন, তিনি পরবর্তীতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হন। ১০ মিনিটের ভেতর যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন স্বীকৃতি দেয়। এভাবে আরব ফিলিস্তিনিদের সব আশা ভরসাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে কায়েম হয় ইসরাইল। আরবরা কোনোদিন তা মেনে নেয়নি। যেমন মেনে নেয়নি দাহরান। ইতিহাসের বইতে ফিলিস্তিনের এই বিবরণ পড়ে তার চোখ ছল ছল করে ওঠে। আহা এক সময়ের আমাদের বাড়িগুলো এখন জোর করে দখলে নিয়েছে ইহুদি হার্মাদগুলো। এদের শাস্তি দিতে যা যা করা দরকার সে বড়ো হয়ে তাই করবে। এটা তার শপথ।
৫.
দাহরানের প্রিয় শহর খান ইউনুস। এটি দক্ষিণ গাজা উপত্যকার একটি শহর আর খান ইউনুস গভর্নরেটের রাজধানীও। ১৪ শতকের আগে খান ইউনুস “সালকাহ” নামে পরিচিত একটি গ্রাম ছিল। কাফেলা, তীর্থযাত্রী এবং ভ্রমণকারীদের সুরক্ষার জন্য ১৩৮৭-৮৮ সালে আমির ইউনুস আন-নুরুজি নামক মামলুক সাম্রাজ্যের একজন কর্মকর্তা সেখানে একটি বিশাল কাফেলা সরাই নির্মাণ করেন।
ঐতিহাসিক হেরোডোটাস লেক সার্বোনিস এবং কাডিটিস (আধুনিক গাজা শহর) এর মধ্যে অবস্থিত আইনিসোস নামের একটি শহরের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি আরও বর্ণনা করেছেন যে কীভাবে ক্যাডিটিস এবং আইনিসোসের মধ্যবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলে স্থানীয় আরব উপজাতিদের বসবাস ছিল। নামগুলির ধ্বনিতাত্ত্বিক সাদৃশ্য এবং ভৌগলিক অবস্থানগুলোর সাধারণ মিলের কারণে কিছু উৎস এই সাইটটিকে আধুনিক খান ইউনুসের সাথে যুক্ত করে। তীর্থযাত্রী এবং ভ্রমণকারীদের সুরক্ষার জন্য ইউনুস আন-নুরুজি কাফেলা সরাই নির্মাণ করায় এর আশপাশের ক্রমবর্ধমান শহরটির নাম তার নামানুসারে রাখা হয়েছিল ‘খান ইউনুস’। ১৩৮৯ সালের যুদ্ধে ইউনুস নিহত হন। ইউনুস ইবনে আবদুল্লাহ আন-নুরুজি আদ-দাওয়াদার ছিলেন নির্বাহী সচিব (দাওয়াদার), যিনি মামলুক সুলতান বারকুকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একজন। শহরটি বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এবং এর সাপ্তাহিক বৃহস্পতিবারের বাজারটি পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করেছিল।
১৫১৬ সালের শেষের দিকে খান ইউনুস একটি ছোটো যুদ্ধের স্থান ছিল যেখানে সিনান পাশার নেতৃত্বে উসমানীয় বাহিনীর কাছে মিসর-ভিত্তিক মামলুকরা পরাজিত হয়েছিল। অটোমান বা উসমানীয় সুলতান সেলিম প্রথম মিসর জয় করার জন্য সিনাই উপদ্বীপ জুড়ে অটোমান সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এলাকায় পৌঁছেছিলেন। ১৭ ও ১৮ শতকে অটোমানরা খান ইউনুসের দুর্গ রক্ষার জন্য কায়রো সিটাডেলের সাথে যুক্ত একটি অ্যাসপেস গ্যারিসন নির্মাণ করেছিল। বিশিষ্ট জরিপকারক পিয়েরে জ্যাকোটিন ১৭৯৯ সালে তার মানচিত্রে কান জোনেস গ্রামের উল্লেখ করেছিলেন, যখন রবিনসন খান ইউনুসকে গাজা জেলায় অবস্থিত একটি মুসলিম গ্রাম হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। ১৮৬৩ সালে ফরাসি অভিযাত্রী ভিক্টর গুয়েরিন খান ইউনুস ভ্রমণ করেন। তিনি দেখতে পেলেন যে এর প্রায় এক হাজার বাসিন্দা রয়েছে এবং অনেক ফলের গাছ, বিশেষ করে এপ্রিকট লাগানো হয়েছে। ১৯ শতকের শেষের দিকে উসমানীয়রা খান ইউনুসের বিষয়গুলো পরিচালনা করার জন্য একটি পৌরসভা প্রতিষ্ঠা করে, যা গাজার পরে গাজা জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে পরিণত হয়েছিল। ১৯৫৫ সালের ৩১ আগস্ট রাতে তিনটি ইসরাইলি প্যারাট্রুপ কোম্পানি খান ইউনুসের ব্রিটিশ-নির্মিত টেগার্ট দুর্গে আক্রমণ করেছিল। এই দুর্গ থেকে ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। প্রচণ্ড যুদ্ধে ৭২ জন মিসরীয় সৈন্য নিহত হয়। এতে একজন ইসরাইলি সেনা নিহত এবং ১৭ জন আহত হয়। অপারেশনটি ৪ সেপ্টেম্বর একটি যুদ্ধবিরতির দিকে পরিচালিত করে, মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের এবং মিসরীয় সরকারকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি ফেদায়িন অভিযান বন্ধ করতে বাধ্য করে।
সুয়েজ যুদ্ধের আগে খান ইউনুস আনুষ্ঠানিকভাবে অল-প্যালেস্টাইন সরকার দ্বারা শাসিত ছিল। ১৯৫৯ সালের পর গাজা স্ট্রিপের অল-প্যালেস্টাইন সরকার বিলুপ্ত করা হয় এবং শহরটিকে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা শীঘ্রই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং গাজা উপত্যকা সরাসরি মিসরীয় সামরিক দখলদারিত্বের অধীনে আসে। ১৯৬৭ সালে যুদ্ধের সময় ইসরাইল আবার খান ইউনুস দখল করে। খান ইউনুস ছিল আগস্ট ২০০১ এবং অক্টোবর ২০০২ সালে ইসরাইলি হেলিকপ্টার হামলার স্থান, যাতে বেশ কয়েকজন বেসামরিক লোক নিহত, শত শত আহত এবং আশপাশের বেসামরিক ভবন ধ্বংস হয়ে যায়।
খান ইউনুস এখন ফিলিস্তিনি হামাসের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত । অক্টোবর ২৩ থেকে চলমান ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে হামাসের বিরুদ্ধে আক্রমণের অংশ হিসাবে ইসরাইল গাজা উপত্যকার অন্যান্য শহরগুলোর সাথে খান ইউনুস-এ বোমাবর্ষণ করেছে।
আল কারারা সাংস্কৃতিক জাদুঘরটি ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরাইলি হামলার ফলে একটি বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এই হামলা আশপাশের বেসামরিক বাড়ি এবং মসজিদকে লক্ষ্য করে করা হয়।
৬.
ফ্লাশ ব্যাক। ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলায় ইসরাইল হয় হতভম্ব আর ফিলিস্তিনিরা করে উল্লাস। সেদিন ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়ে গাজা উপত্যকার সব মানুষ। যেন তারা যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। দাহরান মায়ের কাছে না বলে এই প্রথম বাজারের দিকে যায়। তারপর যায় খান ইউনুসের ভার্সিটির দিকে। দেখে সেখানে শত শত ফিলিস্তিনি জড়ো হয়েছে। তারা বিজয় মিছিল শুরু করে। সেই মিছিলে যোগ দেয় দাহরান। আম্মুকে না বলে আসার কারণ হচ্ছে বললে আম্মু আসতে দেবে না। অন্য দিকে তার মন পড়ে আছে সেখানে। মায়ের বকুনি খাওয়ার কথা ভুলে সে চলে আসে ভার্সিটি স্কয়ারে। সবাই স্লোগান দিচ্ছে ডাউন উইথ ইসরাইল। ইসরাইল নিপাত যাক। স্টপ জেনোসাইড। গণ হত্যা বন্ধ করো। উই ওয়ান্ট ফ্রিডম। আমরা স্বাধীনতা চাই।
রাতে বাড়ি ফিরলে বোন তান্নাহ পেছনের দরজা খুলে দেয়। একসময়ে আম্মুর সামনে পড়লেও তাকে কিছু বলেননি। অবাক হয় দাহরান।
৮ অক্টোবর ২০২৩। পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয় সাত তারিখের আক্রমণের খবর। একটি পত্রিকা লিখেছে- আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ইসরাইলের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়েছিল মিসর ও সিরিয়া। যা ইওম কিপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এবারে একই উপায়ে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরাইলের ওপর বড়ো ধরনের আক্রমণ শুরু করেছে। এবারও ইহুদিদের ছুটির সময়ে এই অপ্রত্যাশিত হামলার ঘটনা ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে গাজা উপত্যকায় উত্তেজনা ঘনীভূত হচ্ছিল। সেখানকার শাসক দল হামাস অথবা ইসরাইল কেউ-ই সেই উত্তেজনা আর বাড়াতে চায়নি। তবে হামাস একটি গোছানো আর সমন্বিত অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেছিল। রবিবার সকালে তারা জেরুসালেম এবং তেল আবিব পর্যন্ত একের পর এক রকেট নিক্ষেপ শুরু করে। সেই সাথে ফিলিস্তিনি ওই যোদ্ধারা সমুদ্র, স্থল এবং আকাশপথে দক্ষিণ ইসরাইলে প্রবেশ করে। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইসরাইলি শহর ও সেনা ঘাঁটিগুলো ঘেরাও করে আক্রমণ করে এবং বহু মানুষকে হত্যা করে। সেই সাথে তারা অজ্ঞাত সংখ্যক ইসরাইলি বেসামরিক নাগরিক ও সৈন্যদের গাজায় জিম্মি করে রাখার জন্য ধরে নিয়ে যায়। এই ভয়াবহ ঘটনাপ্রবাহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মূলধারার গণমাধ্যমে সরাসরি প্রচারিত হয়েছে।
এই পর্যন্ত পড়ে শিহরিত হয় দাহরান। না, আরেকটু পড়তে হবে। সে কাগজখানা নিয়ে দোতলা বাড়িটির ছাদে উঠে যায়। তারপর পাতাটি মেলে ধরে। এতে লেখা আছে- গাজার আশপাশের এলাকাগুলোয় যারা বাড়ির বাইরে খোলা মাঠে রাতভর উৎসব করছিল তারা হঠাৎ করে গোলাগুলির মুখে পড়ে যায়। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পার্টিতে আসা লোকজন তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য ছোটাছুটি করছে। সেই রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে এদের একজন গিলি ইয়োসকোভিচ বিবিসিকে জানান যে কীভাবে তিনি ভারী ভারী অস্ত্রধারী যোদ্ধাদের থেকে নিজেকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলেন। “তারা প্রতিটি গাছের কাছে যাচ্ছিল এবং সব জায়গায় গুলি করছিল। দুই দিক থেকে দেখলাম চারিদিকে মানুষ মরছে। আমি ধরে নিলাম, ঠিক আছে, আমি মরতে যাচ্ছি, ঠিক আছে, নিজেকে বলছিলাম শ্বাস নাও, চোখ বন্ধ করো, কারণ [সেখানে] সর্বত্র গোলাগুলি চলছে। তারা আমার খুব কাছাকাছি ছিল।”
পরবর্তীতে ইয়োসকোভিচের সঙ্গী গাড়ি চালিয়ে তাকে খুঁজে বের করেন এবং সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। ইসরাইলের হাইয়োম পত্রিকায় কিবুতজ বেইরি শহরের এক বাসিন্দাকে উদ্ধার করা হয়। যিনি তার বাবাকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলেন। রকেট হামলার সতর্কীকরণ সাইরেন বেজে ওঠার পর তার বাবা একটি নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলেন। তিনি আমাকে লিখেছিলেন যে, “অস্ত্রধারীরা আশ্রয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আমি গাজার ভেতর থেকে ফেসবুক আর টেলিগ্রামে তার ছবি দেখছিলাম। আমি এখনও গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এমন পরিস্থিতিতে ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর সাধারণ মানুষের সাহায্যে যত দ্রুত এগিয়ে আসার কথা ছিল তারা সেভাবে আসেনি। এতে অনেক ইসরাইলি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।” এ পর্যন্ত পড়ে আবার থামে দাহরান। হামাস যোদ্ধাদের এই বীরত্বে সে নিজেও গর্বিত।
দাহরান পরের অংশে যায়। লেখা আছে- হামাস চ্যানেলে শেয়ার করা ফুটেজে দেখা গেছে যে, সশস্ত্র যোদ্ধারা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ঘাঁটি এবং একটি সাঁজোয়া যানে থাকা সৈন্যদের বন্দি করছে এবং হত্যা করছে। শুরুতে গাজায় উৎসব উদযাপনের বেশ কিছু ছবি দেখা যায়। সেখানে ছিনিয়ে নেওয়া কয়েকটি ইসরাইলি সামরিক যান রাস্তা দিয়ে চালিয়ে নিতে দেখা যায়। “আল-আকসায় ইসরায়েলি অভিযানের প্রতিশোধ নিতে হামাস এখন পর্যন্ত যা যা করেছে তাতে আমি খুশি।” গাজা শহরের এক যুবক বিবিসিকে এ কথা জানায়। আবার থামে দাহরান। কারণ সে নিজেও খুশি। আর গাজায় উৎসবে সে-ও যোগ দিয়েছিল। গর্বে তার বুকটা ভরে যাচ্ছে।
হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তীতে কী ঘটবে তার জন্য আতঙ্কে আছে সবাই। দাহরানও। ২০২১ সালের যুদ্ধে ইসরাইলের হামলার কারণে শোরুক টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এতে তাদের আত্মীয়ের পরিবার একটি দোকান হারায়। এবার হামাস অনেক বড়ো আকারে হামলা চালিয়েছে, তাই ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া আরও বড়ো হবে বলে শঙ্কা সবার। ইসরাইলি বিমান হামলায় আহতদের ভিড়ে ফিলিস্তিনি হাসপাতালগুলো ইতোমধ্যে সয়লাব হয়ে গেছে।
গাজা উপত্যকা উপকূলীয় এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি গাদাগাদি হয়ে বসবাস করেন। হামাস পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার এক বছর পরে ২০০৭ সালে এই গাজা উপত্যকার দখল নেয়। এরপর ইসরাইল এবং মিসর তখন তাদের অবরোধ আরও কঠোর করে তোলে।
না সবটা জানতে হবে। দাহরান আবার পত্রিকার পাতায় ডুব দেয়। এতে লিখেছে- এই অভিযানের মাধ্যমে হামাস আবারও নিজেদের নতুনভাবে জাহির করতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে। যারা ইসরায়েলের ধ্বংসের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আক্রমণের শুরুতে হামাসের কমান্ডার, মোহাম্মদ দেইফ ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য আরবদের “ইসরায়েলি দখলদারিত্ব দূর করার” অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। দাহরানের পরিবারের টাইটেলও দেইফ। মোহাম্মদ দেইফের মাঝে সে নিজেকে খুঁজে পায়।
পরিস্থিতি ভালো নয় এটা বুঝতে পারে দাহরান। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী ব্যাপকভাবে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে। গাজায় তীব্র বিমান হামলার পাশাপাশি তারা সেখানে স্থল অভিযানের পরিকল্পনা করছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
না, এর পরও ভীত নয় দাহরান। সাহস হারালে চলবে না। এটা সে বড়ো ভাইয়ের কাছ থেকে জেনেছে।
৭.
মায়ের ডাকে পত্রিকা পড়ার অবসান ঘটে দাহরানের। তান্নাহর সাথে নিচে নেমে আসে ছাদ থেকে। আম্মু বলেন-
: তোর বাবা আজও আসবেন না। তোমার ভাইয়েরও দেখা নেই। বাজারে যেতে হবে কিছু আনাজ পাতি আনতে।
: তা যাব মাম্মাহ।
: তোকে আজ খুশি খুশি লাগছে।
: না মম, কিছু নয়।
: বল না।
দাহরান কাচুমাচু করে। ভাবে কিছু বলা ঠিক হবে কি না।
: মম, ওরা না ভিতুর ডিম। আল কাসসাম ব্রিগেডের ভয়ে ইহুদিরা সেঁটিয়ে গেছে।
: তুই জানলি কী করে?
: পত্রিকা পড়ে। কী যে খুশি লাগছে না মম! তুমি তো জানো না সব খবর।
: জি হ্যাঁ, আমি সব জানি। আপনার আগে আমি সব পড়েছি। মা দাহরানকে অবাক করে দিয়ে বলেন।
: ওহ। থেমে যায় দাহরান। টাকা ও বাজারের থলে নিয়ে বের হয়ে পড়ে।
৮.
সুন্দর রোদ উঠেছে আজ। মনে হচ্ছে পুরো খান ইউনুস শহর রোদের আলোয় হাসছে। নিজেদের দোতলা ভবন থেকে বের হয়ে দাহরান ডানে মোড় নেয়। আল মারকাজুল প্লাজার সামনে এসে থামে। এই সময়েও সেখানে জানাজা হবে। একটি কিশোরের জানাজা। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে। মনে হয় কাল রাতে শহীদ হয়েছে। রাতে দীর্ঘক্ষণ সাইরেনের শব্দ শুনেছে। আর শুনেছে বোমারু বিমানের আওয়াজ। তারপর বিস্ফোরণ আর দাউ দাউ আগুন। কোন দিকে কী হয়েছে রাতে ঠাহর করতে পারেনি। ওদের দুরুমের বাসায় এমনিতে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। মাম্মাম হাসপাতালে ছিল বলে মায়ের বিছানা ফাঁকা ছিল। ছোটো বোন তান্নাহর সাথে ঘুমিয়েছে। বড়ো বোন জান্নাহ ছিল আরেক খাটে। মায়ের বিষয় নিয়ে ভাবনাতে আসলে কেউ ঘুমাতে পারেনি। ওর মায়ের অসুখ করেছে শুনে হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে ছুটে এসেছেন বাবা। কত দিন বাবাকে দেখে না দাহরান। বাবা তো তার কর্মক্ষেত্র হাসপাতালকে বাড়ি বানিয়ে নিয়েছেন। হাসপাতালে ছুটি মেলা খুব কঠিন। এমনকি ঈদের দিনেও ডিউটি করতে হয়। এবার অবশ্য তা হয়নি। সেই ঈদের দিন বাবাকে দেখেছিল দাহরান।
ঝিরি ঝিরি বাতাসে খেজুর পাতা কাঁপছে। কাঁপছে নিম গাছের পাতা। এর আরেক নাম জিয়া ট্রি। চারাগুলো দিয়েছে সৌদি সরকার। খেজুর পাতা ও জিয়া ট্রির পাতা দিব্যি দোল খাচ্ছে বাতাসে। যেন কিছুই হয়নি। ইসরাইল গোলা নিক্ষেপ করেনি, ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়েনি। কী আশ্চর্য! প্রকৃতি এত নিষ্ঠুর হয় কী করে? ভেবে পায় না দাহরান।
জানাজায় যোগ দেওয়া হয় না তার। বাজার করে দ্রুত বাসায় ফিরতে হবে। এরি মাঝে কড় কড় করে বাজ পড়ার শব্দ হয়। তারপর জঙ্গী বিমান উড়ে যাওয়ার শব্দ। সাইরেনের শব্দ। দ্রিম দ্রিম। গোলা ও গুলি এসে পড়তে লাগলো তার সামনে ও পেছনে।
না ভয় পেলে চলবে না। সাহস রাখতে হবে। কে যেন ভেতর থেকে বলছে-
: দাহরান, তুমি না যুদ্ধে যেতে চাও? তাহলে ভয় কীসের? ভয়কে জয় করে যুদ্ধে যেতে হয়। এখন কিশোর যে যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। দাহরান জবাবে বলে-
: আমি ভয় করি না। আমি যুদ্ধে যেতে চাই। ভেতরের কণ্ঠটা চুপ হয়ে যায়।
কড়াৎ। শব্দ করে একটা গোলার বড়ো স্পিøন্টার আছড়ে পড়ে সামনে। জানাজা ছেড়ে লোকগুলো নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে দৌড়ে যায়। লাশবাহী খাটিয়াটা পড়ে আছে সামনে। বাতাসের হলকায় লাশের ওপরের সাদা চাদর সরে যায়। কাফনে জড়ানো হয়নি। এত সময় কোথায়? হামাসের পতাকায় জড়িয়ে দাফন করা হয় লাশ। একটু দূর থেকে মুখটা দেখে চমকে যায় দাহরান। এযে তার ক্লাসমেট জাওয়াদ আল হুসেনের লাশ। দৌড়ে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে সে।
: জাওয়াদ! জাওয়াদ! ততক্ষণে মূর্চ্ছা যাওয়ার অবস্থা তার। পাশ থেকে কয়েকজন এসে তাকে সরিয়ে নেয়।
খাটিয়া কাঁধে নিয়ে চলছে অন্তিম যাত্রার দল। মুখে কলেমা। বুকে ঈমানের বল।
৯.
দাহরানকে একদল স্বেচ্ছাসেবী বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে। তার আর বাজার সওদা করা হয়নি। দুই বোন তার পাশে বসে শুশ্রƒষা করছে। কিছুক্ষণ আগে তার জ্ঞান ফিরেছে। জাওয়াদ জাওয়াদ করে আবার মুর্চ্ছা যাওয়ার উপক্রম। জান্নাহ আর তান্নাহর চোখে ক্লান্তি। তবু ভাইয়ের জন্য যা করা যায় করছে।
: দাহরান, চোখ মেল ভাই। তান্নাহ ডাক দেয়।
হ্যাঁ বলে খানিকটা চোখ মেলে আবাব চোখ বন্ধ করে দাহরান।
: কিছু একটা খেয়ে নে। তোর জন্য বড়ো আপু সুজির হালুয়া করেছে। তোর তো খুব পছন্দ। খাবি একটু?
দাহরান কথা বলে না। জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় তান্নাহ।
আবার সন্ধ্যা নামে ওদের মহল্লায়। বোমা পড়ে। নারী-শিশু মারা যায়।
আবার ভোরও হয়। তবে আজকের ভোর একটু আলাদা। শান্ত সমাহিত ভোর। রোদের ঝলমলে আলো চারদিকে।
১০.
কয়েকটি দিন কেটে গেছে। দাহরানের মায়ের অসুস্থতা কাটেনি, জটিল হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন অপুষ্টি থেকে এসব হচ্ছে। কয়েকটা ছেলেমেয়ে নিয়ে দিনভর খাটুনি। খাওয়াদাওয়া হয় না ঠিকমতো। এর ফলে মা হান্নাহ বিনত হামেদ রোগা হয়ে পড়েছেন। আর উদ্বাস্তু জীবনে দুটি মাত্র কক্ষে অস্বাস্থ্যকর বসবাস সমস্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। তবু মা আল্লাহর শোকর করেন। আল্লাহ যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তার শোকর আদায় করতে হয়। এই শিক্ষা তিনি পেয়েছেন বাবা হামেদ আর মা জায়েদার কাছ থেকে। নিজের ছেলেমেয়েদেরও এ শিক্ষা দিচ্ছেন তিনি। আর তার কাতর অবস্থায় ছেলেমেয়েরা আরো কাতর হয়ে পড়েছে। স্বামীকে পাশে পেয়ে তার অবস্থা কিছুটা ভালোর দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই খারাপের দিকে টার্ন নিয়েছে। তাকে শেষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গাজা সিটির আল শিফা হাসপাতালে। খান ইউনুস শহর থেকে চব্বিশ কিমি দূরে। এটা এখানকার বড়ো হাসপাতাল। এক দুপুরে ইসরাইলি গোলা নিক্ষেপের মধ্যেই তাকে শিফট করা হয়।
তিনি এখন শুয়ে আছেন আল শিফা হাসপালের একটি সাদা বেডে। হাসপাতালের সবকিছু সাদা কেন হয় ভেবে পায় না দাহরান। বেড সাদা, পর্দা সাদা, দেওয়াল সাদা, ডাক্তার নার্সদের পোশাক বা এপ্রন সাদা। মায়ের শিয়রে বসা দাহরান। মায়ের কাছে থাকলে তার ভালো লাগে। তার হাসি মুখ দেখে সে ভাবে মাম্মামও হয়তো ভালো বোধ করেন।
হাসপাতালটির অবস্থাও ভালো নয়। বোমা হামলায় আর ক্ষেপণাস্ত্রের গোলার স্পিøন্টারের টুকরো এখানে সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে। কোনো কোনো অংশে দেওয়াল ভাঙ্গা। হানাদারদের হাত থেকে হাসপাতালও রক্ষা পাচ্ছে না। যুদ্ধের সময় হাসপাতাল রেড ক্রস, রেড ক্রিসেন্ট সেন্টার নিরাপদ এলাকা হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু ইসরাইলি বর্বররা সেটা মানলে তো। বলতে গেলে ক্রমাগত হামলায় আল-শিফা হাসপাতালটি এক রকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে ইসরাইলি বাহিনী। সেখানে জীবনের সব অনুভূতি ধ্বংস করে দিয়েছে তারা। হাসপাতালের বেশ কিছু ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে বহু লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অনেক স্থান পুড়ে কালো হয়েছে। বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কংক্রিটের আস্তরণ। অন্ধকার করিডরে পড়ে রয়েছেন কয়েকজন রোগী। আল-শিফা প্রাঙ্গণে যে কবরস্থান তৈরি করা হয়েছিল তা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। অবস্থা বর্ণনাতীত। দখলদার বাহিনী জীবনের সব অনুভূতি ধ্বংস করে দিয়েছে।
আরো ধ্বংসের বিভীষিকা নিয়ে এলো ১ এপ্রিলের কালো দিনটি। একটি আগুন রাঙা দিন। হাসপাতাল ভবনে বেশ কয়েকবার বিমান ও গোলা হামলার ঘটনা ঘটে। পুরো হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এ এক পৈশাচিক কাজ। কোনো মানুষ এমনটা করতে পারে? সেটাই ভাবছিল দাহরান। হাসপাতালের একটি বেডে তার মাম্মাম শায়িত। সে পাশে আছে। এমন সময় শোঁ শোঁ গর্জন ও দ্রিমি দ্রিমি দ্রুম করতে করতে ইসরাইলি জঙ্গী বিমান হানা দেয়। আঘাতের পর আঘাত গোলার পর গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। প্রথমে ছুটোছুটি শুরু হয় ভেতরে। কারণ বাইরে কেউ নেই। গোলার আঘাত থেকে বাঁচতে সবাই ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু তা যে আশ্রয়স্থল হবে না কে জানতো।
গোলার শব্দ পেয়ে প্রথমে মাকে বেড থেকে নামায় দাহরান। মাকে খুবই হালকা মনে হয়। মনে হচ্ছে একটি শোলার পুতুল। তার পর রুমের কর্নারে একটি বেডে নিয়ে শুইয়ে দেয়। যদি বেঁচে যাওয়া যায় এই আশায়। পাশে জবুথবু হয়ে বসে থাকে দাহরান। মা ভীত চোখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছেন। বাবা কোথায় যেন গেছেন। সম্ভবত কোনো রিপোর্ট আনতে। গোলার একটা আঘাতে হাসপাতাল ভবনের একটি কর্নার ধসে যায়। যেন হুমড়ি খেয়ে রোদ ঢুকে পড়ে। ঢুকে পড়ে আলো। তারা কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই হুড়মুড়িয়ে সেখানে ঢোকে ইহুদি সেনারা। ভারি ভারি তাদের পোশাক। কিম্ভুত কিমাকার। হাতে হাতে তাক করা আগ্নেয়াস্ত্র। অত্যাধুনিক রাইফেল, সাব মেশিন গান।
মাম্মাম থরথর করে কাঁপতে থাকেন। কাঁপন দেখা দেয় দাহরান আর আশপাশের অন্য বেডের রোগীদেরও। কালেমা পড়া ছাড়া আর কি করার আছে এ সময়? দাহরান ও তার মা কলেমা পড়তে থাকে।
দু’জন সেনা কাছাকাছি আসে। একজন বলতে থাকে-
: হল্ট হল্ট। ডোন্ট ট্রাই টু এস্কেপ।
: কিল দেম অল। আরেক জন বলে। অস্ত্রের ভাষা, অস্ত্রধারীদের ভাষা কি এ রকম হয়? ভাবার চেষ্টা করে দাহরান। কিন্তু ভাবার সময় কোথায়?
একজন ইহুদি সেনা অস্ত্র তাক করে ট্রিগার টিপে দেয়। মুহূর্তে ঝাঝরা হয়ে যায় রুমের ভেতরে থাকা সবার শরীর। গুলি খেয়ে মায়ের বুকে আছড়ে পড়ে দাহরান। যেন পরম শান্তি সেখানে। ততক্ষণে মায়েরও জীবন প্রদীপ নিভে গেছে। তিনিও হাত দিয়ে আগলে ধরার চেষ্টা করেন ছেলেকে। একটু পর আল শিফা হাসপাতাল ভবনের ছাদও ধসে পড়ে। দাহরান ও তার মায়ের নিথর দেহ চাপা পড়ে কংক্রিটের নিচে।