শেখ হাসিনা পালানোর পর থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। বিশেষত নরেন্দ্র মোদি সরকারের শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ যখন চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করছে, তখন ভারতকে ঢাকা এবং বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
গত বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর চীন বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারের সঙ্গে একাধিক আলোচনা করেছে। এর বিপরীতে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেকটাই থেমে গেছে।
সম্প্রতি ভারতের সিদ্ধান্তে হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ায় ঢাকা থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে প্রত্যর্পণ করার অনুরোধে ভারতীয় সরকারের উদাসীনতা এবং বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ভারতীয় মিডিয়ার ভুয়া সহিংসতার খবরের কারণে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে।
লন্ডনভিত্তিক চিন্তাভাবনাকেন্দ্র চ্যাথাম হাউসের এশিয়া-প্যাসিফিক প্রোগ্রামের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো চেঠিজিগ বাজিকী বলেছেন, ‘অন্তবর্তী সরকার এমন দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছে, যাদের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্ক জটিল ছিল। শুধু চীন নয়, পাকিস্তানের সঙ্গেও। যা পারস্পরিক সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।’
গত মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বেইজিং সফরে যান এবং চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ির সঙ্গে বৈঠক করেন।
দ্য ডেকান হেরাল্ডের এক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে সাউথ চিনা মর্নিং পোস্ট জানায়, সফরকালে ওয়াং ইয়ি তৌহিদ হোসেনকে বলেছেন, ‘চীন বাংলাদেশকে তার জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় মর্যাদা রক্ষা করতে সহায়তা করতে চায়। বাংলাদেশি জনগণের পছন্দকে সম্মান করে এমন একটি উন্নয়ন পথ অনুসন্ধানে সহায়তা করতে আগ্রহী।
তক্ষশিলা ইসস্টিটিউশনের চীনবিষয়ক রিসার্চ বিশ্লেষক রাক্ষিত শেটি বলেছেন, ‘ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকার চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে। বিশেষ করে চীনা সোলার প্যানেল কারখানাগুলো বাংলাদেশে স্থানান্তর করার প্রস্তাব দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ফেলো জোশুয়া কুরলানজিক বলেন, ‘ইউনূস শিগগিরই বেইজিং সফর করতে পারেন এবং ঢাকা জন্য আরও সহায়তা ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।’
কুরলানজিক বলেন, ‘ইউনূস চীনা সহায়তা এবং বিনিয়োগ সংগ্রহে বড় ভূমিকা পালন করছেন। তিনি চীন থেকে ঋণ মাফ এবং নতুন চীনা প্রকল্পগুলোর ওপর কম সুদের হার চাইছেন।’
চীন বাংলাদেশে তার উন্নয়ন মডেল এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এ বিষয়ে শেটি বলেন, ‘এটা দিল্লির জন্য আরও কম অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন করার সুযোগ তৈরি করতে পারে।’
চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার, ২০২৩ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১৬৮.৪ বিলিয়ন ইউয়ান বা ২৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, যা বেশিরভাগ চীনা রপ্তানির অন্তর্ভুক্ত।
সম্প্রতি, দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তানের পর, চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র ক্রেতা বাংলাদেশ। বাংলাদেশ চীনের জে-১০সি যুদ্ধাবিমান কেনার মাধ্যমে তার বিমানবাহিনী আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা করছে।’
শেটি দিস ইউক ইন এশিয়াকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক ভারতের নিরাপত্তার হিসাবকে জটিল করে তুলতে পারে, বিশেষত ভারতের পূর্ব সীমান্তে।’
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাড়তি উত্তেজনার লক্ষণ হিসেবে সম্প্রতি ভারতীয় সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী (বিএসএফ) এর কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণ থামিয়ে দেয় বাংলাদেশিরা।
ইউনূস প্রশাসনের অধীনে ইসলামপন্থী বন্দিদের মুক্তি ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এদিকে, পাকিস্তান ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ এবং বাংলাদেশের মধ্যে উচ্চস্তরের সামরিক সম্পর্কও দিল্লিতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
গত মাসে, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তা এস এম কামরুল হাসান পাকিস্তানে একটি বিরল সফর করেন। যেখানে তিনি দেশটির প্রতিরক্ষা সচিব মুহাম্মদ আলি এবং শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একই মাসে, একটি পাকিস্তানি সামরিক প্রতিনিধি দল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের সংবেদনশীল অঞ্চলে সফর করেছে।
সূত্র: সাউথ চিনা মর্নিং পোস্ট