রোজা শুরু মানেই খাবারের সময় ও নিয়ম পরিবর্তন হয়ে যাওয়া। ডায়াবেটিক রোগীরা অবশ্যই রোজা রাখতে পারবেন। তবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে ডায়াবেটিসের অবস্থা, নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়, ডায়াবেটিস নিয়ে রোজা রাখার নিয়ম জেনে নিলে ভালো। সম্ভব হলে রোজা রাখার জন্য শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ ঠিক আছেন কি না, এ জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষাও করিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এক সমীক্ষায় জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস আক্রান্ত ৫০ কোটির বেশি মানুষ রোজা পালন করে।
চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি কারণ, কিছু ডায়াবেটিক রোগীকে রোজা রাখতে নিষেধও করা হয়। কখন রোজা ভাঙতে হবে, রোজায় কীভাবে ডায়াবেটিস মাপতে হবে, এ বিষয়েও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে যাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রোজা রাখেন, তাঁরা কিছু জটিলতার সম্মুখীন হন। বিশেষ করে রক্তে সুগারের স্বল্পতা (হাইপোগ্লাইসেমিয়া), রক্তে সুগারের আধিক্য (হাইপারগ্লাইসিমিয়া), ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস, পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশনে ভোগেন।
খাদ্যতালিকার পুনর্বিন্যাস:
প্রত্যেক ডায়াবেটিক রোগীকে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। সেগুলো হচ্ছে
* ক্যালরি মেপে সাহ্রি, ইফতার ও ডিনার বা রাতের খাবার খেতে হবে।
* প্রতি বেলার খাবারে কম শর্করাযুক্ত ও উচ্চ আঁশযুক্ত খাবার রাখতে হবে।
* খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল, সবজি বা সালাদ থাকতে হবে।
* অতিরিক্ত মসলাদার, ভাজাপোড়া, মিষ্টান্ন বা মিষ্টিজাতীয় তরল বা শরবত এড়িয়ে চলতে হবে।
* ইফতার থেকে সাহ্রি পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি বা তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।
ওষুধের নির্দেশনা
রোজার মধ্যে খাবারের নিয়ম পরিবর্তন হয়ে যায়। এ জন্য ইনসুলিনও সেভাবে পরিবর্তন করে নিতে হবে। ইফতারের সময় ইনসুলিনটা বেশি নিতে হবে। ওষুধের ডোজগুলো ইফতারের সময় বেশি হবে। সাহ্রির পর লম্বা সময় খাবার খাওয়া হয় না। এ জন্য ইনসুলিন এবং অন্য ওষুধের পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন যে ওষুধগুলো স্বল্প সময় কাজ করে, সেগুলো পরিবর্তন করে দীর্ঘ মেয়াদে কাজ করে, এমন ওষুধ নিতে হবে। প্রয়োজনে সাহ্রির সময় ইনসুলিনের পরিমাণ কমাতে হবে।
কখন রোজা ভেঙে ফেলতে হবে
১. যদি রক্তে সুগারের মাত্রা <৭০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার বা <৩.৯ মিলিমোল/লিটার হয়।
২. যদি রক্তে সুগারের মাত্রা >৩০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার বা >১৬.৬ মিলিমোল/লিটার হয়।
৩. রোজা পালনকালে রক্তে সুগার কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে (যেমন বুক ধড়ফড়, হাত-পা কাঁপা, খিঁচুনি অতিরিক্ত স্বরে আওয়াজ, অবসাদগ্রস্ততা ইত্যাদি) বা বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে (যেমন অতিরিক্ত পানি পিপাসা, অতিরিক্ত ক্ষুধা, অবসাদগ্রস্ততা, অতিরিক্ত প্রস্রাব, বমি ভাব বা বমি, তীব্র পেটব্যথা ইত্যাদি) অথবা পানিশূন্যতা দেখা দিলে, এমনকি অন্য যেকোনো তীব্র শারীরিক অসুস্থতার সময়।
ঝুঁকি
রোজায় ডায়াবেটিক রোগীরা যে ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন, তা হলো সুগার অত্যধিক মাত্রায় কমে যাওয়া, যেটিকে বলা হয় হাইপোগ্লাইসেমিয়া। যদি কারও রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ প্রতি লিটার ৪ মিলিমোলের (প্রতি ডেসিলিটারে ৭০ মিলিগ্রাম) কম হয়ে যায়, তবে এটিকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলা হয়। আবার কারও যদি রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ প্রতি ডেসিলিটারে ৩০০ মিলিগ্রামের ওপরে উঠে যায়, তবে সেটিকে বলে হাইপারগ্লাইসেমিয়া।
রোজার মাসে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে আমূল পরিবর্তন হয়। অনিয়ন্ত্রিত খাবারে সুগার বেড়ে যেতে পারে। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারে। এর বাইরে আরও কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। মানুষ সাধারণত বছরের ১১ মাস দিনের বেলায় বেশি খাবার খায়, রাতের বেলায় কম খাবার খায়। রোজার মধ্যে সব খাবার রাতে খাওয়া হয়। ফলে দিনে দীর্ঘ সময় খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়। পানি না খেয়ে থাকতে হয়, এ জন্য পানিশূন্যতা তৈরি হয়। এতে মানুষের রক্তজমাট বাঁধার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
কখন রক্তের সুগার পরীক্ষা করবেন
রোজা পালন অবস্থায় কখন রক্তের সুগার পরীক্ষা করবেন, তা নির্ভর করে প্রত্যেক রোগী কী ধরনের ডায়াবেটিসের ওষুধ সেবন করছেন তার ওপর। যেসব রোগী ইনসুলিন বা সালফোনাইল ইউরিয়া গ্রুপের ওষুধ সেবন করছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে দিনের একাধিক সময়ে রক্তে সুগার চেক করার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া দিনের যেকোনো সময়ে কোনো ব্যক্তির যদি হাইপো বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে সুগার কমে বা বেড়ে যাওয়ার যেকোনো লক্ষণ অনুভূতি হলে। অন্যান্য যেকোনো শারীরিক অসুস্থতার সময় দিনে একাধিক বার রক্তে সুগার চেক করতে হবে এবং প্রয়োজনে রোজা ভেঙে ফেলতে হতে পারে।
ছবি: পেকজেলসডটকম