পৃথিবীতে গয়না আছে বিভিন্ন ধারার। কিছু গয়নায় বিত্ত প্রকাশ পায়, আবার কিছু গয়নায় শিল্প। সেরা যেন ফুলের গয়না। গরমে বৈশাখী সাজে আরাম আর সতেজতা—দুটোই ফুটে ওঠে ফুলের গয়নার সাজে।
গ্রীষ্মের বিকেলে এক বর্ষীয়ান নারী বারান্দায় মোড়া পেতে বসে আছেন। হাতপাখায় বাতাস করছেন নিজের গায়ে। সেই বাতাসে তাঁর কপালের কাছের রুপালি চুলগুলো উড়ছে। গরমকাল বলে ঘাড় থেকে একটু উঁচুতে চুল খোঁপা করে বাঁধা। পরনে সরু পাড়ের সাদা শাড়ি, কানে দুটি সদ্য ফোটা বেলিফুল। এই দৃশ্য আমার স্মৃতি থেকে নেওয়া। সেই নারী আমার নানু।
আমি সেদিন দেখেছিলাম এক বর্ষীয়ান রূপসীকে। গ্রীষ্মের বিকেলের আলোয় সাদা শাড়ি আর কানে সাদা ফুলে তাঁর পুরো সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়েছিল সদ্য ফোটা বেলির মতোই। ফুলের গয়নার প্রসঙ্গ উঠলে আমার বারবার এ দৃশ্যটাই স্মৃতি থেকে উঠে আসে।
পৃথিবীতে গয়না আছে বিভিন্ন ধারার। তার মানে বিভিন্ন রকমেরও। কিছু গয়নায় বিত্ত প্রকাশ পায়, আবার কিছু গয়নায় শিল্প। এই গয়নাই আবার ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্বের পরিচয় বহন করে। তবে আমার কাছে সবার সেরা ফুলের গয়না।
সেই ফুলের গয়নার স্থায়িত্বকাল খুব বেশি হলে এক দিন বা তারও কম। কিন্তু এই অল্প সময়েই সেই ফুলের সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতায় একজন নারীকে অপরূপ করে তুলতে পারে। অনুষ্ঠানে–আয়োজনে সবার মধ্যে তিনি হয়ে উঠতে পারেন বন থেকে তুলে আনা ফুলেরই মতো। প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য করে হয়ে উঠতে পারেন প্রকৃতিরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ফুলের গয়নার উপকরণ হিসেবে নিতে পারি বাজারের কেনা ফুল, বাগানের আদরের ফুল থেকে শুরু করে অনাদরে বেড়ে ওঠা বুনো ফুল, ঘাসের ফুল ও বীজ, নানা ধরনের পাতা। নানা ধরনের ফুলের গয়না আমরা ঘরে বসেই বানাতে পারি। ফুল দিয়ে চুল সাজাতে পারি নানা ভঙ্গিমায়।
খোঁপা অথবা চুল সাজানোর ফুল পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে বাছাই করলেই ভালো হয়। যেমন গোলাপি শাড়িতে গোলাপি গোলাপ অথবা বাগানবিলাস। খোঁপার পাশে একগুচ্ছ ফুল গুঁজে দিলে মনে হয়, ফুলগুলোকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তার বদলে দু–তিনটি ফুল, কিছু পাতা, একটি-দুটি কলি একসঙ্গে করে খোঁপা সাজালে মনে হবে বাগানেরই একটি অংশ খোঁপায় উঠে এসেছে; সঙ্গে কিছু ঘাসফুলও দেওয়া যেতে পারে।
কল্পনা করি, একটি মেয়ে পরে আছে শেওলা সবুজ তাঁতের শাড়ি ও সাদা ব্লাউজ। দুই কানে পরেছে পাতার দুল। সেই পাতার দুলে আছে রঙ্গন, বেলি, পেয়ারা আর নিমের পাতা। চার রকমের পাতা থেকে পাওয়া গেল চার রকমের সবুজ। অপূর্ব সুন্দর কম্বিনেশন হলো তার গয়না ও শাড়ির। গলায় হয়তো পরেছে ছোট ছোট কাচ পুঁতির গোছা মালা।
১০ থেকে ১৫টি পাতা একসঙ্গে সুতায় গেঁথে লকেটের মতো করে বেঁধে দেওয়া হলো পুঁতির লম্বা মালায়। হয়ে গেল পাতার মালা। এমন একটি ভিন্ন সাজে সেই মেয়েটি সবার নজর কাড়তে বাধ্য। তথাকথিত বহু মূল্যবান সোনা–রুপার গয়নাও এই তাঁতের শাড়ি আর পাতার গয়নার কাছে ম্লান হতে পারে।
কল্পনা করি, একজন কিশোরী হালকা বেগুনি রঙের কুচির ঘেরওয়ালা স্কার্ট পরেছে। সঙ্গে হালকা সবুজ খাটো কুর্তা। তার ঢেউখেলানো লেয়ার কাট চুলগুলো খোলা। মাথায় পরেছে কামিনীপাতা দিয়ে বানানো একটি মুকুট। মুকুটটি শুধু পাতা দিয়েই তৈরি নয়, তাতে গুঁজে দেওয়া হয়েছে বেগুনি রঙের গ্ল্যাডিওলাস ফুলের আধফোটা কলি আর অল্প সাদা জিপসি ফুলের গুচ্ছ—স্কার্টের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে। মুকুটে পাতার আধিক্য বেশি। ফুলগুলো যেন পাতার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে।
কল্পনা করি, ষাটোর্ধ্ব এক বর্ষীয়ান নারী। রুপালি ধূসর চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা; কিন্তু পরিপাটি। পরেছেন দুধরঙা শাড়িতে সবুজ, হলুদ, নীল আর ধূসর রঙের ডোরাকাটা চওড়া পাড়; হালকা সবুজ ব্লাউজ। দুই কানে দুটি মাত্র সাদা চন্দ্রমল্লিকা ফুল। তাঁর মুখের কুঞ্চিত বলিরেখার সঙ্গে যেন মিলে গেছে চন্দ্রমল্লিকার পাপড়ির ভাঁজ। এই স্নিগ্ধ ফুল দুটি যেন তাঁর বয়সকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। ফুলের স্নিগ্ধতায় বর্ষীয়ান নারী হয়ে উঠেছেন অপরূপ।
এ ছাড়া আমরা গয়না বানাতে পারি জবার কলি দিয়ে। জবার কলির নেকলেস ঠিক যেন বিছাহার। একইভাবে রজনীগন্ধার কলি দিয়েও হার বানানো যায়। যেকোনো কাঁচা সবুজ পাতা খিলির মতো করে বেঁধে সেই খিলির ভেতরে ছোট ছোট ফুল গুঁজে অপূর্ব সুন্দর পাতার নেকলেস বানানো যায়।
ঝরে পড়া শুকনা পাতা দিয়েও পাতার খিলির গয়না খুব সুন্দর হয়। ফুলেল সৌন্দর্যে নারী হয়ে উঠতে পারেন অপরূপ। নারীর মনোজগৎ–জুড়ে চর্চিত হোক ফুলেল সাজের নতুন নতুন ডিজাইন, নতুন নতুন আইডিয়া। আবারও মনে পড়ছে সেই বর্ষীয়ান সুন্দরী আফতাবন নেসা, যিনি আমার নানু। গ্রীষ্মকালজুড়ে যাঁর কানে শোভা পেত সুগন্ধি বেলি।
লেখক: দেশালের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার