একজন মানুষ যত বড় হতে থাকে, আস্তে আস্তে পারিপার্শ্বিকতা বুঝতে শুরু করে। ছোটবেলায় ভালো-মন্দ বোধ যেখানে ছিল না, সেখানে আস্তে আস্তে গড়ে উঠতে থাকে পরিমিতিবোধ। কখন কার সঙ্গে কী করা যাবে, কী করা যাবে না, সেই জ্ঞান গড়ে ওঠে অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে। এসব সামাল দিতে না পেরে সামাজিক পরিস্থিতিতে গিয়ে অনেকেই নার্ভাস হয়ে পড়েন, এই নার্ভাসনেসই হলো ‘সোশ্যাল অ্যাংজাইটি’।
অনেকের ধারণা, নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি গড়ে ওঠে। ব্যাপারটি তেমন নয়। সোশ্যাল অ্যাংজাইটি গড়ে ওঠার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যখন থেকে একটি শিশু তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝতে শুরু করে, তখন থেকেই তার মধ্যে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি গড়ে উঠতে পারে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোরদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি তুলনামূলক বেশি। এই গবেষণার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল শিশুদের প্রিয় ভিডিও গেমস।
৭ থেকে ১৭ বছর বয়সী ২১৪ জন শিশুর ওপর চালানো হয় এই গবেষণা। ‘জার্নাল অব চাইল্ড সাইকোলজি অ্যান্ড সাইকেট্রি’ থেকে চালানো এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য। প্রত্যেককে একটি গেমের সামনে বসিয়ে গবেষকেরা দেখতে চেয়েছিলেন ভুল করার পর তারা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়। ভিডিও গেমে ভুল করা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। কিন্তু এই স্বাভাবিক বিষয়টি বয়সভেদে প্রভাব ফেলছে শিশুদের ওপর। ১১ বছরের নিচের শিশুদের ছোট্ট ভুল করার পর গেমে মনোযোগ দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। অন্যদিকে ১১ বছরের ওপরের শিশুরা খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পেরেছিল।
অ্যাংজাইটি যখন থেকে মনে বাসা বাঁধতে শুরু করে, তখন থেকেই মানুষ ছোটখাটো ভুল করতে শুরু করে। কাজ সম্পন্ন করতে না পারলে কিংবা ভুল করলে তার ফলাফল কী হতে পারে, এমন ভয়ও থাকে মনে। ফলে হুট করে প্যানিক করা, কাজে ফোকাস করতে না পারার মতো ঘটনা ঘটে। এমন ছোটখাটো বিষয় শিশুদের মনে বড় প্রভাব ফেলে।
তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শিশুরা নিজেদের মানিয়ে নিতে শুরু করে। ভিডিও গেমের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিশেষ করে চোখে পড়েছে গবেষকদের। ব্যর্থ হওয়ার পর অপেক্ষাকৃত ছোট শিশুরা যখন নার্ভাস হয়ে পড়েছে, বড় শিশুরা সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করেছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শিশুরা নার্ভাসনেসের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করে। শিশুদের নার্ভাসনেস কাটাতে তাই মা-বাবার প্রয়োজন আলাদা করে নজর রাখা।
৭ থেকে ১৫ বছরের শিশুদের মধ্যে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি গড়ে উঠতে শুরু করে। বেশির ভাগ শিশুই তা মুখ ফুটে বলতে পারে না, বরং তা লুকিয়ে রাখে। বেশির ভাগ মা-বাবা শিশুর এই চুপচাপ থাকাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেন। বিশেষ করে ঘরের বাইরে অপরিচিত মানুষজনের সামনে শিশুরা বেশ চুপচাপ হয়ে যায়। ‘অন্যরা কী ভাববে’এমন চিন্তা বাসা বাঁধে তাদের মনেও।
চাইল্ড মাইন্ড ইস্টিটিউটের সাইকোলজিস্ট জেরি বাবরিক বলেন, ‘শিশুরা যে নার্ভাসনেস কিংবা ভয় থেকে এমন চুপসে যায়, ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং তাদের মনেও অন্যরা তাদের নিয়ে কী ভাববে—এমন চিন্তাভাবনা থাকে। বেশির ভাগ মা-বাবা তা ধরতে পারেন না।’
ক্লাসে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, ক্যানটিনে খেতে বসা থেকে শুরু করে হুট করে কোনো ভুল করে ফেলা; এসব চিন্তা মাথায় খেলে তাদের মনে।
এই নার্ভাসনেস কাটানোর জন্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে শিশুর মা-বাবা। শিশু ভয় পাচ্ছে কি না, তাদের মনে নার্ভাসনেস গড়ে উঠছে কি না, এই বিষয়ে খেয়াল রাখার দায়িত্ব তাঁদের। শিশুর সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা; তার ভালোমন্দ খোঁজ রাখা; স্কুলে কিংবা খেলার মাঠে তার আচরণ ও গতিবিধি সম্পর্কে নজর রাখা—এমন ছোটখাটো বিষয়ে লক্ষ রাখলেই বুঝতে পারবেন শিশুর মধ্যে নার্ভাসনেস গড়ে উঠছে কি না। বেড়ে ওঠার বয়সে এমন নার্ভাসনেসের প্রভাব টিকে থাকতে পারে আজীবন। তাই খেয়াল রাখতে হবে শুরু থেকেই।