এখানে জাদু দেখানো হয়—সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর প্রবেশপথে আগামীকাল চাইলে এমন কিছু লিখে রাখতে পারে রিয়াল মাদ্রিদ। নাহ, বার্নাব্যুর সবুজ মাঠ কোনো জাদু দেখানোর মঞ্চ না। কোট–টাই পরা কোনো জাদুকর মঞ্চে এসে আস্তিনের ভাঁজ থেকে বের করে আনবেন না সাদা কবুতর। কিংবা সবার চোখ কপালে তুলে সেই জাদুকর মানুষ কেটে জোড়াও লাগাবেন না। এই জাদু স্রেফ মনস্তাত্ত্বিক একটি চাপ।
বার্নাব্যুর গেটে এমন কিছু লেখা না থাকলেও এরই মধ্যে সেই চাপ বার্নাব্যু ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মাদ্রিদ থেকে সড়ক পথে ১,৭৩১ কিলোমিটার দূরের শহর লন্ডনেও। চাপটা এমন যে একটা দল চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে ৩–০ গোলে জিতেও স্বস্তিতে থাকতে পারছে না। সান্তিয়াগো বার্নাব্যু নামের এক অদৃশ্য চাপ আপনাই ভর করেছে লন্ডনের ক্লাব আর্সেনালের ওপর।
লন্ডনে এমিরেটস স্টেডিয়ামে প্রথম লেগের দ্বিতীয়ার্ধে রিয়ালকে নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করেছে আর্সেনাল। ডেকলান রাইসের অবিশ্বাস্য দুটি ফ্রি–কিক গোল এবং সব মিলিয়ে সেদিন তিন গোল হজমের বিব্রতকর অভিজ্ঞতা হয় রিয়ালের। এমন হারের পর যেকোনো দলেরই মনোবল ভেঙে যায় কিংবা চুপচাপ থেকে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে লড়াইয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা।
কিন্তু রিয়াল মোটেই সেটা করেনি। উল্টো বিধ্বস্ত হওয়ার পর ‘বার্নাব্যুতে ৯০ মিনিট অনেক লম্বা’ কিংবা ‘একটা জায়গাতেই পাগলাটে ব্যাপারগুলো ঘটে, আর সেটা আমাদের ঘর’—এমন বাণী নিয়ে হাজির হতে শুরু করেন রদ্রিগো–জুড বেলিংহামরা। এসবের অর্থ একটাই, বার্নাব্যুতে মাঠে নামার আগেই আর্সেনালের মনোবল গুঁড়িয়ে দেওয়া।
শুধু সমর্থক কিংবা বর্তমান খেলোয়াড়েরাই নন, সাবেক খেলোয়াড়েরাও যোগ দিয়েছেন ‘বার্নাব্যু ক্যাম্পেইন’–এ। রিয়াল কিংবদন্তি মার্সেলো যেমনটা বললেন, ‘কখনোই রিয়াল মাদ্রিদকে বাতিল করে দিতে পারবেন না। যদিও তিন গোল অনেক বেশি। কিন্তু রিয়ালের ওপর আমার বিশ্বাস আছে যে তারা পারবে। রিয়াল মাদ্রিদ সব সময় ঘুরে দাঁড়াতে পারে। পরের লেগটি বার্নাব্যুতে। সমর্থকেরা সর্বোচ্চটা দেবে এবং খেলোয়াড়দের এই আত্মবিশ্বাস আছে যে তারা পারবে।’
একই কথা বলেছেন গত মৌসুমে বার্নাব্যুতে বায়ার্ন মিউনিখকে হারানোর নায়ক হোসেলুও, ‘আমার মনে হয় মাদ্রিদের বিশেষ কিছু একটা আছে, বিশেষ করে বার্নাব্যুতে। যদি তারা শুরুতে গোল করতে পারে, তবে গোটা বার্নাব্যুকে তারা সঙ্গে পাবে।’
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই প্রচারণা কি কাজ করে? অবশ্যই করে। নয়তো আর্সেনালের প্রথম লেগে এত বড় জয়ের পর মিকেল আরতেতার দলকে কেন টিকে থাকার বা হার এড়ানোর পরিকল্পনা করতে হবে! কেনই–বা আরও আগ্রাসী ফুটবল খেলে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাববে না আর্সেনাল?
কথায় আছে, ‘বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়।’ সেই ‘বাঘ’কে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে আর্সেনাল নিজেই তৈরি করেছে।
তিন গোলে এগিয়ে থাকার পর তো আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হওয়ার কথা এবং প্রতিপক্ষকেই আতঙ্কে রাখার কথা। কিন্তু চিত্রটা পুরোপুরি উল্টো। হঠাৎ করে কারও মনে হতে পারে, আর্সেনাল নয়, রিয়ালই বোধ হয় তিন গোলে এগিয়ে! ফলে প্রথম লেগে বড় ব্যবধানে হেরেও রিয়াল যে এরই মধ্যে মানসিকভাবে বাড়তি সুবিধা নিয়ে নিয়েছে, সেটা বলাই যায়।
আর্সেনাল যে দল হিসেবে মানসিকভাবে কতটা নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে, তা দলটির মিডফিল্ডার মিকেল মেরিনোর কথায় অনেকটাই স্পষ্ট, ‘যা ঘটবে তার সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নিতে হবে এবং মনোযোগী থাকতে হবে। মানসিকতার দিক থেকে আমরা প্রতিদিন কাজ করছি। কোচ আমাদের চাপের পরিস্থিতিতে ফেলে অনুশীলন করাচ্ছেন এবং যেকোনো ধরনের ম্যাচের জন্য প্রস্তুত করছেন।’
মেরিনোর কথাতেই স্পষ্ট, রিয়ালের ঘুরে দাঁড়ানোর ‘অভ্যাস’ নিয়ে আর্সেনাল আতঙ্কিত। কথায় আছে, ‘বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়।’ সেই ‘বাঘ’কে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে আর্সেনাল নিজেই তৈরি করেছে। শেষ পর্যন্ত এই ‘বাঘ’ তাদের খাবে নাকি ‘বাঘ বধ’ করে আর্সেনালই রাজা হয়ে উঠবে, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে এই ‘বাঘ’ যে আর্সেনালের সহজ কাজকে কঠিন করতে তুলতে পারে, সে আশঙ্কা করাই যায়।
আর্সেনালের ‘বার্নাব্যু আতঙ্ক’ এরই মধ্যে স্পষ্ট রিয়ালের কাছেও। ফলে রিয়াল আরও মরিয়া হয়ে উঠেছে। স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম মার্কা জানিয়েছে, আজ রাতের ম্যাচে ১৮ বছরের নিচে এবং ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে সব দর্শককে বার্নাব্যুতে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হবে না। ছয় ঘণ্টা আগে বন্ধ করে দেওয়া হবে বার্নাব্যুর ছাদও। এসব শুনে কারও মনে হতে পারে খেলা নয়, রিয়াল আসলে প্রস্তুতি নিচ্ছে কোনো যুদ্ধের। সে জন্য তারা তৈরি করেছে ব্যক্তিগত ‘কুরুক্ষেত্র’। যেখানে প্রতিপক্ষকে দরজা–জানালা বন্ধ রেখে নির্মমভাবে গুঁড়িয়ে দিতে চায় তারা।
রিয়ালের এমন প্রস্তুতির কারণ অবশ্য কারও অজানা নয়। অতীতে এই মাঠে ঘুরে দাঁড়ানোর এমন অনেক উপাখ্যান তারা লিখেছে। ২০১৫–১৬ চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনাল প্রথম লেগে ভলফসবুর্গের বিপক্ষে ২–০ গোলে হেরেছিল রিয়াল। ফিরতি লেগে বার্নাব্যুতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হ্যাটট্রিকে রিয়াল জিতেছিল ৩–০ গোলে।
গত মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষেও বার্নাব্যুতে ফিরে আসার অবিশ্বাস্য গল্প লিখেছিল রিয়াল। সেবার প্রথম লেগে আলিয়েঞ্জ অ্যারেনার ম্যাচটি ড্র ছিল ২–২ গোলে। এরপর ফিরতি লেগে আগে গোল খেয়ে পিছিয়েও পড়ে রিয়াল। ৮৭ মিনিট পযর্ন্ত দুই লেগ মিলিয়ে ৩–২ গোলে পিছিয়ে ছিল তারা।
কিন্তু এরপরই শুরু হয় বার্নাব্যুর জাদু দেখানোর পালা। অখ্যাত এক হোসেলু আকস্মিকভাবেই আবির্ভূত হন নায়ক হিসেবে। তিন মিনিটে দুই গোল করে ভেঙে দেন বায়ার্নের ফাইনাল–স্বপ্ন। একইভাবে বলা যায়, ২০২১–২২ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালের কথা। প্রথম লেগে ম্যানচেস্টার সিটির মাঠে ৪–৩ গোলে হেরেছিল রিয়াল। এরপর বার্নাব্যুর দ্বিতীয় লেগে ৭৩ মিনিটে রিয়াদ মাহরেজের গোলে আরও পিছিয়ে পড়ে তারা।
দুই লেগ মিলিয়ে ৮৯ মিনিট পর্যন্ত রিয়াল পিছিয়ে ছিল ৫–৩ গোলে। এমন পরিস্থিতিতে জয়ের কথা হয়তো খোদ রিয়াল সমর্থকেরাও হয়তো ভাবেননি। কিন্তু ৯০ মিনিট ও যোগ করা সময়ে প্রথম মিনিটে জোড়া গোল করে পুরো দৃশ্যপট বদলে দেন রদ্রিগো। এরপর অতিরিক্ত সময়ে করিম বেনজেমার পেনাল্টি গোল নিশ্চিত করে রিয়ালের ৬–৫ গোলের জয়।
এগুলো শুধুই দৃষ্টান্ত নয় এবং মঞ্চের নাম যদি চ্যাম্পিয়নস লিগ হয়, তবে তো আরও নয়। এই মঞ্চে এসব ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প রিয়াল নিয়মিত লিখে থাকে। ফলে আর্সেনালের আতঙ্ক একেবারেই অমূলক কিছু নয়। রিয়াল যদি শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়িয়ে আর্সেনালকে হারিয়ে দেয়, তবে আপনি মুখ বাঁকিয়ে বলতেই পারেন, ‘আরে, এ আর নতুন কী, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল!’
তাই চেনা গল্প বদলানোর চ্যালেঞ্জ রিয়ালের নয়, বরং আর্সেনালেরই!