বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এপ্রিল-মে মাসজুড়ে চলা প্রচণ্ড গরম ও তাপপ্রবাহে সুস্থ এবং কর্মক্ষম থাকা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ সময় অতিরিক্ত ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে প্রচুর পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট বের হয়ে যায়। যার ফলে পানিশূন্যতা, ক্লান্তি, মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, খাদ্যে অরুচি দেখা দেয়। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও অতিরিক্ত ওজনের মানুষেরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। সময়মতো প্রয়োজনীয় সতর্কতা না নিলে পানিশূন্যতা হিটস্ট্রোকে রূপ নিতে পারে। তাই গরমের মৌসুমে সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
গরমে শরীর ঠাণ্ডা রাখতে যেসব খাবার খাবেন
গরমে শরীর ঠাণ্ডা ও হাইড্রেট রাখতে কিছু নির্দিষ্ট খাবার বিশেষভাবে উপকারী-
🔸 তরলজাতীয় খাবার: তরমুজ, শশা, লাউ ইত্যাদির ৯০ শতাংশেরও বেশি অংশ পানি। এগুলো দেহের ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালেন্স ঠিক রাখে এবং ঠাণ্ডা অনুভূতি দেয়।
🔸 ঠাণ্ডা দুধ ও দই: দইয়ের প্রোবায়োটিকস হজমশক্তি বাড়ায় ও শরীরের অতিরিক্ত উত্তাপ কমায়। মাঠা, ঘোল শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট পূরণ করে।
🔸 মৌসুমি ফল ও শাকসবজি: লেবু, পেপে আনারস,আম, জাম, বেল, জামরুল, আমলকি প্রভৃতি ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফলে ভরা, যা শরীরের ভিতরের উত্তাপ কমাতে সাহায্য করে। শসা, টমেটো, লাউ, ঢেঁড়স, পটল ইত্যাদি হালকা সবজি সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর।
🔸 ডাবের পানি: প্রাকৃতিক ইলেক্ট্রোলাইটের উৎস। ক্লান্তি দূর করে এবং শরীর ঠাণ্ডা রাখে।
🔸 প্রাকৃতিক ঠাণ্ডা মশলা ও হার্বস: পুদিনা, ধনেপাতা, জিরা, সৌফ, গোলাপ জল, তুলসীপাতা ইত্যাদি শরীরে ঠাণ্ডা অনুভূতি এনে দেয় ও হজমের উন্নতি করে।
গরমে স্বস্তি পেতে খাদ্যাভ্যাসের নির্দেশিকা
১. পানি পান করুন নিয়মিত: দিনে অন্তত ১০-১২ গ্লাস পানি পান করুন। দীর্ঘসময় বাইরে থাকলে প্রতি ১৫-২০ মিনিট পর ১ কাপ পানি পান করা উচিত। তবে মাত্রাতিরিক্ত পানি পানও ঠিক নয়। ওভারহাইড্রেশন রক্তে সোডিয়াম কমিয়ে দিতে পারে। কিডনি, যকৃৎ, হৃদরোগীদের ক্ষেত্রে পানি পান চিকিৎসকের পরামর্শে হওয়া উচিত।
২. প্রাকৃতিক পানীয় বেছে নিন: বাসায় তৈরি লেবুপানি, চিরা ভেজানো পানি, ডাবের পানি, টক দইয়ের শরবত খান। কোক, সোডা জাতীয় পানীয় এড়িয়ে চলুন, এগুলো শরীরে পানিশূন্যতা বাড়ায়।
৩. শসা ও পানিসমৃদ্ধ খাবার বেশি খান: শসা, তরমুজ, বাঙ্গি, আম, লেবু জাতীয় ফল প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখুন। এগুলো শরীরকে ঠাণ্ডা রাখে ও পানিশূন্যতা প্রতিরোধ করে।
৪. সতর্ক থাকুন বিশেষ খাবারের বিষয়ে: ড্রাই ফ্রুটস যেমন খেজুর, কিসমিসের মতো হালকা শুকনো ফল খান। মাছ, ডিম, দুধ, দই, মুগ ডাল, ছোলার ছাতুর শরবত স্বাস্থ্যকর প্রোটিনের ভালো উৎস।
গরমে যেসব খাবার এড়িয়ে চলবেন
গ্রীষ্মকালে শরীরের নিজস্ব ‘থার্মোরেগুলেশন’ প্রক্রিয়া কাজ করে শরীর ঠাণ্ডা রাখে; কিন্তু কিছু খাবার শরীরে ‘থার্মোজেনেসিস’ বাড়িয়ে শরীর আরও উত্তপ্ত করে তোলে। যেমন-
🔸 মসলা ও ঝালজাত খাবার: ঝাল মরিচ, গোলমরিচ, আদা, রসুনে থাকা ক্যাপসাইসিন শরীরের মেটাবলিজম বাড়িয়ে তাপ উৎপন্ন করে।
🔸 গরু ও খাসির মাংস: উচ্চ প্রোটিনযুক্ত এসব খাবার হজমের সময় শরীরে অতিরিক্ত তাপ তৈরি করে।
🔸 ভাজাপোড়া ও ফাস্ট ফুড: অতিরিক্ত তেল ও ক্যালরি শরীরে ‘মেটাবলিক ওভারলোড’ ঘটায়, ক্লান্তি বাড়ায়।
🔸 কড়া চা, কফি ও রাস্তার খোলা খাবার ও শরবত : শরীরকে ডিহাইড্রেট করে এবং জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
এছাড়া পোলাও, বিরিয়ানি, কাচ্চি, সোডা জাতীয় পানীয় ও ধূমপানের মতো অভ্যাসও গরমে শরীরের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। এগুলো এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
গরমের মৌসুমে অতিরিক্ত সতর্কতা যা মানতে হবে
✔️ রোদে অতিরিক্ত সময় না থাকা বা পরিশ্রম বা ব্যায়াম না করা
✔️ ছায়াযুক্ত ঠাণ্ডা জায়গায় থাকা
✔️ ঢিলেঢালা হালকা রঙের কাপড় পরা
✔️ বাইরে গেলে ছাতা ও পানি সঙ্গে রাখা
এই প্রচণ্ড গরমে সুস্থ থাকতে খাদ্যাভ্যাসে সচেতন হওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক ও সহজপাচ্য খাবারের দিকে ঝুঁকুন, শরীরের পানি ও ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখুন। নিজেকে ও পরিবারের সবাইকে এই গরমে সতর্ক রাখুন, বিভিন্ন রোগের প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
লেখক: পুষ্টিবিদ, বায়োজিন কসমোসিউটিকেলস