ভারত-পাকিস্তানের এবারের এই উত্তেজনার সূত্রপাত গত মাসে, কাশ্মীরের ভারত-নিয়ন্ত্রিত অংশে এক পর্যটকবহরে ভয়াবহ হামলার মাধ্যমে। ওই হামলায় ২৫ জন ভারতীয় ও ১ জন নেপালি নাগরিক নিহত হন। ভারত এর দায় পাকিস্তানের ওপর চাপায়। ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করে স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
দুই দেশই একে অন্যকে দোষারোপের পর পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে। পরিস্থিতি ক্রমেই যুদ্ধের দিকে গড়িয়েছে। এক সামরিক মহড়ায় পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির একটি ট্যাংকের ওপর উঠে সেনাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, ‘ভারতের যেকোনো ধরনের আগ্রাসনের জবাব হবে তৎক্ষণাৎ, কঠিন এবং আরও শক্তিশালী।’ জাতীয় নিরাপত্তাবিশ্লেষক ও অধ্যাপক ভরত কারনাড মনে করেন, পুরো পরিস্থিতি এখন মুনিরের হাতে। তাঁর ভাষায়, মুনির একটু উগ্র ধাঁচের মানুষ।
অন্যদিকে পাকিস্তানের সাবেক তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরীর মতে, মূল সমস্যা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর মতে, ‘মোদি এখন রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা। ভোটের হার কমে যাচ্ছে। তাই কাশ্মীরের সীমানা বদলে দিয়ে নিজের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে চান তিনি।…আমি মনে করি, তিনি যুদ্ধক্ষেত্র আরও বিস্তৃত করবেন।’
২০১৬ ও ২০১৯ সালে কাশ্মীর নিয়ে শেষবার দুই দেশের মধ্যে বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। তখন পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে এবার মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছে একদল অপ্রত্যাশিত খেলোয়াড়। তারা হলো উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো। বিশেষ করে সৌদি আরব এখন শান্তি প্রতিষ্ঠায় নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবেইর সম্প্রতি হঠাৎ ভারত সফরে আসেন। তিনি বৈঠক করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, উত্তেজনা প্রশমনে সাহায্য করা। সৌদি আরবের পক্ষে এই শান্তির চেষ্টা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, সৌদিতে বর্তমানে প্রায় ২৬ লাখ ভারতীয় শ্রমিক কাজ করেন। সেখানে আছেন প্রায় সমানসংখ্যক পাকিস্তানিও। কাশ্মীর হামলার সময় মোদি ছিলেন জেদ্দায়। সেখানে তিনি ‘ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর’ নিয়ে আলোচনা করছিলেন। সেই সঙ্গে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি নিয়েও কথা হচ্ছিল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উপমহাদেশের চারপাশের কূটনৈতিক ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন এসেছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এখন অনেক বেড়েছে। আগে সেখানে আদর্শ ও ধর্ম ছিল পররাষ্ট্রনীতির চালিকা শক্তি। এখন সেখানে জায়গা নিয়েছে স্বার্থ। এরই উদাহরণ হলো সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা।
একসময় বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের মতো পরাশক্তিগুলো। এখন সৌদি আরব ছাড়াও কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এখানে যুক্ত। তবে তারা তাদের পুরোনো কায়দামতো এখন আর ধর্মীয় সংহতির দোহাই দিয়ে আগুনে ঘি ঢালছে না। কাশ্মীর সমস্যায় কাতার ও আরব আমিরাত পাকিস্তানকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। এমনকি ভারতের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছে কাতার। অন্তত ভারতের সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী এমনটাই বলা হচ্ছে।
পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত ও বিনিয়োগ অংশীদার এখন চীন। ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার সময় ব্যবহার হয়েছিল চীনের তৈরি জে-১০সি যুদ্ধবিমান এবং তাদের নিজস্ব পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র। কাশ্মীর নিয়ে চীনেরও আলাদা স্বার্থ আছে। চীনের নিয়ন্ত্রণে আছে ভারতের সীমান্তঘেঁষা কাশ্মীরের অঞ্চলটি। ফাওয়াদ চৌধুরী বলেন, ‘চীনের এই সংঘাত থেকে দূরে থাকার কোনো উপায় নেই। ওই অঞ্চলে সীমান্ত পরিবর্তন নিয়ে ভারতের যদি কোনো নিজস্ব পরিকল্পনা থাকে, সেটা চীন মানার কথা নয়। ফলে এই সংঘাত কেবল ভারত-পাকিস্তানের ব্যাপার নয়, এর সঙ্গে চীনের স্বার্থও জড়িত।’
বিষয়টি এখানেই থেমে নেই। ধর্ম, আদর্শ বা মূল্যবোধ নয়; এখানে সবকিছুর কেন্দ্রে আছে কেবল স্বার্থ। বহু বছর ধরে পাকিস্তান ধরেই রেখেছিল যে মুসলিম দেশ হিসেবে উপসাগরীয় দেশগুলো তার পাশে দাঁড়াবেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে এই ধারণা বদলানো ছাড়া পাকিস্তানের উপায় নেই। ধর্মীয় পার্থক্য ও আদর্শগত অমিল থাকা সত্ত্বেও ভারত আজ উপসাগরীয় অঞ্চলে এক প্রভাবশালী বড় শক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
অস্ট্রেলীয় বিশ্লেষক সামিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘স্নায়ুযুদ্ধের সময় দেশগুলোর মধ্যে যে শক্তিশালী মৈত্রী দেখা যেত, তা এখন আর নেই। এখন তা দ্রুত বদলে যায়। ভারত-পাকিস্তান দুই দেশই এখন অন্বেষণ করছে যে কে কার থেকে কী পেতে পারে।’
পাকিস্তান যেমন মুসলিম দেশ, তার প্রতিবেশী ইরানও শিয়া মুসলিম দেশ। পাকিস্তানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিয়া মুসলিম বাস করেন। কিন্তু ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের সম্পর্কই তুলনামূলকভাবে বেশি ভালো বলে উল্লেখ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতীয়দের উদ্দেশে আন্তরিক সমবেদনা জানিয়েছে তেহরান।
গত বুধবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসলামাবাদ থেকে সরাসরি দিল্লিতে এসে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন। ইরানের সঙ্গে ভারতের বহু পুরোনো অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এর একটি বড় অংশ চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন ও পরিচালনার সঙ্গে জড়িত। এই প্রকল্পে ভারত ইতিমধ্যে ১২ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য দিয়েছে আরও ২৫ কোটি ডলারের ঋণ। উপসাগরীয় অনেক দেশের মতো ইরানও এখন ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারত্বকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলের কোনো পক্ষই চায় না ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আরেকটি যুদ্ধ হোক। তবু অনেক বিশ্লেষকের শঙ্কা যে ভারত-পাকিস্তান হয়তো ইতিমধ্যেই এমন জায়গায় চলে গেছে, যেখান থেকে ফেরত আসা কঠিন। এই উত্তপ্ত অবস্থায় সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হচ্ছে ভারতের নরেন্দ্র মোদির উদ্যোগে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত রেখে ভারতের পক্ষে নতুন করে আলোচনার চেষ্টা। এর জবাবে পাকিস্তান গত ২৪ এপ্রিল ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তি বাতিল করে দিয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, কাশ্মীর সীমান্তের বর্তমান ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ ছিল দুই দেশের মধ্যে একপ্রকার অস্থায়ী সীমা। এখন তা শুধু অস্ত্রবিরতির রেখা। আন্তর্জাতিক আইনে, এ ধরনের সীমানা যেকোনো পক্ষের পক্ষে সামরিকভাবে বদলে ফেলা সম্ভব।
এখন যদি কূটনৈতিকভাবে উত্তেজনা সাময়িকভাবে কমানো গেলেও তা কোনো স্থায়ী সমাধান হবে না। এখন থেকে এই অঞ্চলে শান্তি রক্ষা করতে হলে চাই লাগাতার আন্তরিক এবং সতর্ক মধ্যস্থতা।
- চার্লি ক্যাম্পবেল এডিটর অ্যাট লার্জ, টাইম
টাইম থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ
(১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এরপরেও প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় লেখাটির অনুবাদ প্রকাশিত হলো)