মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি নতুন কর্মী নিয়োগে আপত্তি জানিয়েছে দেশটির মানবাধিকার গোষ্ঠী তেনাগানিতা। তেনাগানিতা বলেছে, বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের আগে ব্যবস্থা (সিস্টেম) এর সংস্কার করতে হবে। চলমান পদ্ধতিগত ব্যর্থতা মোকাবেলা না করে নতুন কর্মী নিয়োগ চলমান মানবিক সংকটকে আরও নাজুক করবে।
শনিবার এক বিবৃতিতে তেনাগানিতা মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ চুক্তির সম্পূর্ণ প্রকাশের পাশাপাশি আটকে পড়া কর্মীদের বেলায় অবিলম্বে বৈধতা এবং চাকরির স্থান নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে।
তেনাগানিতার নির্বাহী পরিচালক গ্লোরিন দাস, নতুন কর্মী নিয়োগের অনুমতি দেওয়ার আগে আরও নিয়োগের উপর জনসাধারণের স্থগিতাদেশ এবং সিস্টেমের সম্পূর্ণ কাঠামোগত সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার পুত্রজায়ায় মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনার পর নিয়োগ পুনরায় শুরু করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশি গণমাধ্যম জানিয়েছে, মালয়েশিয়া একটি নতুন ব্যবস্থার অধীনে ছয় বছরে ১২ লাখ কর্মী নিয়োগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গ্লোরিন বলেন, মালয়েশিয়ার এখন যা প্রয়োজন তা হলো আরও বেশি নিয়োগ নয়, বরং একটি বাস্তব হিসাব। পদ্ধতিগত ব্যর্থতার হিসাব, যা ব্যাপক শোষণকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে সক্ষম করেছে।
তিনি বলেন, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ অভিবাসী কর্মীকে মালয়েশিয়ায় আনা হয়েছিল, যার মধ্যে ৩ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশ থেকে এসেছে, যার মধ্যে অনেকেই বেকার, অবৈতনিক এবং আটকা পড়েছেন।
অনেককে মিথ্যা আশ্বাসের মাধ্যমে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল, কর্মীদের কাছ থেকে নিয়োগ ফি হিসেবে ২৫,০০০ রিঙ্গিত পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা নিজেদেরকে বেকার, অবৈতনিক, গৃহহীন এবং গ্রেফতারের ঝুঁকিতে ফেলেছিল। ওই সব কর্মীরা এখনও ঋণের বুঝা মাথায় নিয়ে কাজ না পেয়ে দিগ্বিদিক ছুটছে। কেউ কেউ কাজ না পেয়ে এবং ভিসা না থাকায় অবৈধ হয়ে পড়েছে।
গ্লোরিন দাবি করেন যে তেনাগানিতা কমপক্ষে ১৫০টি কোম্পানি চিহ্নিত করেছে, যারা প্রকৃত ব্যবসায়িক কার্যক্রম না থাকা সত্ত্বেও কর্মী নিয়োগের কোটা পেয়েছে।
সরকারি সংস্থাগুলির সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং অনুমোদন ছাড়া এই কর্মীরা অস্তিত্বহীন চাকরির জন্য মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে পারত না। সঠিক পদ্ধতিতে নতুন কর্মী নিয়োগে দুই দেশের সরকারের সংশ্লিষ্টরা দায়িত্ব নিতে হবে বলে জানালেন তেনাগানিতার নির্বাহী পরিচালক গ্লোরিন দাস।
এক বছর বন্ধ থাকার পর কয়েকটি শর্তে খুলছে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার। শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মানবপাচার ও মানিলন্ডারিংয়ের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা, শ্রমিকের নিরাপত্তা ও স্বার্থ সংরক্ষণ করে অভিবাসন ব্যয় কমানো এবং অভিবাসন ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে সহযোগী এজেন্সি প্রথা বাদ দেওয়া।
বৃহস্পতিবার (১৫ মে) মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাশুসন ইসমাইল এবং মানবসম্পদ মন্ত্রীর স্টিভেন সিম চি এর সঙ্গে যৌথসভা করেন বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এ সময় শ্রমিক পাঠানো সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয়। সেই চুক্তিতে এসব শর্ত দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও পাকিস্তানের কাছ থেকে শ্রমিক নেওয়ার বিষয়েও চুক্তি করে মালয়েশিয়া।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সির বেশি টাকা নেওয়ার সুযোগ থাকলে সেখানে বাণিজ্য হয়। শ্রমিক প্রেরণে ব্যয় কম রাখা হলে বাণিজ্য হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
তাছাড়া সহযোগী এজেন্সি (অ্যাসোসিয়েট বেয়ারার) পদ্ধতি অভিবাসন ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। শ্রমিক কম টাকায় মালয়েশিয়া যেতে পারলে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
জানা গেছে, মালয়েশিয়া আগামী কয়েক বছরে প্রায় ১২ লাখ শ্রমিক নেবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য বড় সুখবর রয়েছে।
শ্রমবাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশটিতে সাধারণ শ্রমিকের বেতন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর চাইতে দ্বিগুণ বা তারও বেশি। কিছু জটিলতায় বিশাল এই শ্রমবাজার প্রায় এক বছর ধরে ঝুলেছিল। ধীরে ধীরে সেই জটিলতা কেটেছে। ফলে মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশে রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে।
আগামী ২১ মে ঢাকায় যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্তহবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক ইস্যুতে, এশিয়ার হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট অ্যান্ডি হল বলছেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ২০২১ সালে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকটি (এমওইউ) পুরোপুরি নতুনভাবে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।
এসব চুক্তির এমন কিছু ধারা রয়েছে, যা সিন্ডিকেটদের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, অংশগ্রহণ সীমিতকরণ, খরচ বৃদ্ধি এবং আইনের শাসনকে দুর্বল করার সুযোগ দিয়েছে।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সিন্ডিকেটমুক্ত করতে করণীয় সম্পর্কে অ্যান্ডি হল বলেন, বাংলাদেশের ত্রুটিপূর্ণ এমওইউ সতর্কতার সঙ্গে সংশোধন করতে হবে যেন সব ধরনের সিন্ডিকেটের প্রভাব থেকে অভিবাসী কর্মী নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা মুক্ত করা যায়।
দায়িত্বহীন, অনিয়মিত ও অনৈতিক নিয়োগ পদ্ধতি বহু শ্রমিকের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে তা বাতিল করতে হবে এবং মালয়েশিয়ার সরকারের সঙ্গে ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফডব্লিউসিএমএস)-এর চুক্তি অব্যাহত থাকায় এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কারা অংশ নিতে পারবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ব্যাহত হচ্ছে।
এছাড়া এফডব্লিউসিএমএস-এর হালনাগাদ ওয়েবসাইটে এখনো বাংলাদেশের অনুমোদিত এজেন্সিগুলোর তালিকা প্রকাশিত হয়নি, যদিও অন্যান্য সোর্স কান্ট্রিগুলোর তালিকা সেখানে রয়েছে। এ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, সিন্ডিকেটের শর্ত মেনে নেওয়ার আলোচনা চলার কারণেই তালিকা প্রকাশ বিলম্বিত হচ্ছে।
অ্যান্ডি হল বলেন, শ্রমবাজার খোলার আগেই বাংলাদেশ সরকারের উচিত দ্রুত এমওইউ পুনরায় পর্যালোচনা করে এমন সব ধারা বাদ দেওয়া, যা সিন্ডিকেট গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করে।
গ্লোবাল লেবার অর্গানাইজেশন (জিএলও) এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রধান ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ বলেন, যখন বিশ্ব অর্থনীতি অস্থির এবং পশ্চিমা বাজারে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার অনিশ্চিত, তখন বাণিজ্য এবং শ্রম রপ্তানি উভয়ের জন্য এশিয়ান গন্তব্যগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই প্রেক্ষাপটে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় চালু করার বিষয়ে অব্যাহত অচলাবস্থা গভীরভাবে দুর্ভাগ্যজনক।
এটি অর্ন্তবর্তী সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সদিচ্ছা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে, যা কাঠামোগত সংস্কারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ- অভিবাসী শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
স্থায়ী শ্রমিক সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলা কেবল অপব্যবহার রোধ এবং আইনি চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ সর্বাধিক করার জন্য অপরিহার্য নয়, এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় মানদন্ডের সঙ্গে শ্রম অধিকারের সমন্বয়ের জন্যও একটি পূর্বশর্ত।
এ ধরনের সংস্কারগুলো শেষ পর্যন্ত আসিয়ান সদস্যপদ অর্জনের জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করবে এবং একটি বিশ্বস্ত আঞ্চলিক অংশীদার হিসেবে জড়িত হওয়ার জন্য তার প্রস্তুতি নিশ্চিত করবে।