ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতা, যা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে ছুঁয়ে গেছে। আত্মরক্ষা ও যুদ্ধকৌশলেও ইসলাম এক যুগান্তকারী চেতনার জন্ম দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা তাদের মোকাবিলায় প্রস্তুত করো যতটুকু সম্ভব শক্তি…।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৬০)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় নবীজি (সা.) স্পষ্ট করেন : ‘জেনে রাখো, নিশ্চয়ই ‘শক্তি’ হচ্ছে ‘নিক্ষেপশক্তি’।” (মুসলিম, হাদিস : ১৯১৭)
হাদিসটি এমন এক সামরিক দর্শন তুলে ধরে, যার ভিত্তি হলো দূরপাল্লায় আঘাত হানার সক্ষমতা—যা আজকের ভাষায় ক্ষেপণাস্ত্র বা মিসাইল প্রযুক্তি। তাই মুসলমানরা মধ্যযুগে যুদ্ধকৌশল ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। বিশেষত ‘নিক্ষেপযন্ত্র’ বা দূরপাল্লার হামলার যন্ত্র আবিষ্কার ও ব্যবহারে তারা যুগান্তকারী কিছু উদ্ভাবন করেছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
মিনজানিক (Catapult)
মিনজানিক ছিল মুসলিম বাহিনীর প্রাচীনতম নিক্ষেপযন্ত্রগুলোর একটি। এটি মূলত গ্রিক ও পারস্য থেকে প্রাপ্ত ধারণার ভিত্তিতে ব্যবহার শুরু হয়। ইসলামের সূচনালগ্নেই, নবী মুহাম্মদ (সা.)‑এর সময়ে এটি ব্যবহার হয় ‘তাইফ’ অভিযানে (৮ হিজরি/৬৩০ খ্রিস্টাব্দ)। যন্ত্রটি পাথর, আগুনের গোলা বা অন্যান্য ভারি বস্তু দূরে ছুঁড়ে মারার জন্য ব্যবহূত হতো। এর নির্মাণ কাঠ, দড়ি ও ভার‑প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করত। মুসলমানরা এ প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করেন আব্বাসি ও উমাইয়া আমলে, বিশেষত বাইতুল হিকমার বিজ্ঞানীরা এ যন্ত্রকে দূরপাল্লার ও ভারবহনক্ষম রূপে উন্নত করে তোলেন।
ত্রিবুশে (Trebuchet)
ত্রিবুশে মিনজানিকের একটি উন্নত সংস্করণ। এটি আবিষ্কৃত হয় নবম‑দশম শতকে মুসলিম প্রকৌশলীদের দ্বারা। এ যন্ত্র ভারসাম্য ও পাল্লাভিত্তিক কাঠামো ব্যবহার করে পাথর বা আগুনের গোলা দূরবর্তী শত্রুর ঘাঁটিতে আঘাত হানতে পারত। এটি প্রথম উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যবহূত হয় সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর জেরুজালেম বিজয় অভিযানে (১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ)। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনী ব্যাপকভাবে ত্রিবুশে ব্যবহার করে শত্রু দুর্গ ধ্বংসে। কিছু ঐতিহাসিক সূত্রে এটিকে ‘মাঞ্চেনিক’ বা ‘মুজানিক’ নামেও উল্লেখ করা হয়েছে।
নাফত নিক্ষেপক (Naft Projectors)
‘নাফত’ অর্থ প্রাকৃতিক তেলজাত পদার্থ, যা আগুন জ্বালাতে সক্ষম। মুসলিম বিজ্ঞানীরা একে তরল আগুন হিসেবে সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহারের কৌশল আবিষ্কার করেন অষ্টম শতকে (আব্বাসি যুগ)। বিশেষভাবে তৈরিকৃত পাইপ বা সিফন যন্ত্র ব্যবহার করে এই দাহ্য তরল শত্রুপক্ষের ওপর ছুঁড়ে দেওয়া হতো। এটি ‘আরব ফায়ার’ নামে পরিচিত ছিল এবং ক্রুসেড যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে কার্যকর প্রমাণিত হয়। নাফতের রাসায়নিক উন্নয়নে জাবির ইবনে হাইয়ান (৮ম শতক) ও আল‑কিন্দি (৯ম শতক) বিশেষ অবদান রাখেন।
সিরামিক গ্রেনেড (Ceramic Grenades)
সিরামিক গ্রেনেড ছিল একটি বিস্ফোরক মাটির পাত্র, যার ভেতরে বারুদ বা দাহ্য পদার্থ ভরে শত্রুর দিকে ছুঁড়ে মারা হতো। এটি ৯ম‑১১শ শতকে আব্বাসি ও ফাতিমি শাসনামলে ব্যবহার হতো। সিরিয়া, ইরাক ও মিশরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এসব অস্ত্রের নমুনা পাওয়া গেছে। এগুলো মূলত দুর্গ প্রতিরক্ষা ও ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে রাত্রিকালীন প্রতিরোধে ব্যবহূত হতো। আধুনিক হ্যান্ড গ্রেনেডের এটি একটি আদিম রূপ হিসেবে ধরা যায়।
কামান (Cannons)
মুসলমানরা দশম শতক থেকে কামানের প্রাথমিক ধারণা পায় চীনের বারুদের সূত্র ধরে। তবে এটি বাস্তবে রণক্ষেত্রে প্রয়োগ হয় মমলুক ও অটোমান আমলে। প্রথম পূর্ণমাত্রার কামান ব্যবহূত হয় ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়া‑মিশর এলাকায়। সর্বাধিক আলোচিত কামান ব্যবহার হয় ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ে, সুলতান মুহাম্মদ আল‑ফাতিহ কর্তৃক। তুর্কি প্রকৌশলী উরবান বিশাল এক কামান তৈরি করেন, যার গোলা ছিল প্রায় ৬০০ কেজি ও ১ মাইল দূরত্ব পর্যন্ত পৌঁছাতে পারত। এটি ইউরোপে কামান প্রযুক্তির বিস্তারে অনুপ্রেরণা জোগায়।
রকেট সদৃশ অস্ত্র (Rocket‑like Devices)
১৩শ শতকে মুসলিম প্রকৌশলী হাসান আল‑রাম্মাহ বারুদের সংমিশ্রণ ও অগ্নিচালিত রকেট সদৃশ অস্ত্রের বিবরণ দেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘আল‑ফুরুসিয়্যা ওয়াল‑মানাসিব আল‑হারবিয়্যা’‑তে প্রায় ১০৭টি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক যন্ত্রের বিবরণ রয়েছে। তিনি প্রথম ‘সিলিন্ডার রকেট’ ও ‘বায়ুচাপচালিত আগ্নেয় বস্তু’ নিক্ষেপের ধারণা দেন। এসব অস্ত্র কাঠ বা লোহার নল ব্যবহার করে নিক্ষিপ্ত হতো এবং দূরত্ব অনুযায়ী বারুদের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যেত। অনেক গবেষক একে আধুনিক রকেট প্রযুক্তির ভিত্তি হিসেবে গণ্য করেন।
(আহমাদ ইউসুফ আল‑হাসান, দ্য ডিফারেন্ট অ্যাসপেক্টস অব ইসলামিক কালচার (ভলিউম ৪): মিলিটারি ফায়ারস, গানপাউডার অ্যান্ড ফায়ার আর্মস; ডেভিড নিকোলা, মিডিভাল সিজ উইপনস (২): বাইজ্যান্টাইন, দ্য ইসলামিক ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড ইন্ডিয়া)