মাতৃত্ব ও পিতৃত্বের আনন্দ অতুলনীয়। অজস্র স্বপ্ন বুকে নিয়ে ছোট্ট শিশুর লালন–পালন শুরু করেন মা–বাবা। সন্তানের দায়িত্ব ঠিকঠাক সামলাতে পারা জীবনের এক ভিন্নতর চ্যালেঞ্জ, যা সামলাতে গিয়ে অনেকেই ভুগতে পারেন প্যারেন্টিং স্ট্রেসে। কীভাবে সামলাবেন এই বহুমুখী চাপ? চাপের উৎস ও সামলানোর উপায় সম্পর্কে বলছিলেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. পলাশ রায়।
কেন এত চাপ?
সদ্য হওয়া মা ও বাবার জগৎটাই যেন পাল্টে যায়। আনন্দের অনুভূতির সঙ্গে যোগ হয় কর্তব্যপালনের চাপ। শিশু কাঁদছে কেন, মায়ের দুধ ঠিকভাবে পাচ্ছে কি না, ন্যাপি ভিজিয়ে ফেলল কি না, গরম লাগছে কি না, হজমের সমস্যা হচ্ছে কি না—চিন্তার যেন শেষ নেই। বড় হতে হতে বদলে যায় শিশুর চাহিদা। একই সঙ্গে বদলে যায় মা–বাবার চিন্তার ধরন। শিশু সঠিকভাবে বিকশিত হচ্ছে কি না, পড়ালেখায় অসুবিধা হচ্ছে কি না, সহপাঠীরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে কি না, কেমন বন্ধু পেল সে, তাকে আপনি পর্যাপ্ত সময় দিচ্ছেন কি না, আপনার অনুপস্থিতিতে সে নিরাপদে থাকছে কি না, ইন্টারনেটেই–বা কী দেখছে—চিন্তার চাকা যেন সদা চলমান। শিশুর সব চাহিদা মেটানোর সামর্থ্য হবে কি না, তা নিয়েও দুশ্চিন্তা হতে পারে। এসবের সঙ্গে যোগ হতে পারে অন্য অভিভাবক কিংবা তাঁদের সন্তানের সঙ্গে তুলনার চাপ। ‘আমার সন্তান তো এটা পারে’ কিংবা ‘অমুকের সন্তান তো ওটাও পারছে’ টাইপ কথাও বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
চাই সহজ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন
পৃথিবীর বুকে কেউই নিখুঁত নন। অভিভাবক হিসেবে আপনি অবশ্যই আপনার সেরাটা দেবেন। কিন্তু তা অন্য অভিভাবকের মতো হলো কি না, সেই তুলনায় কখনোই যাবেন না। সন্তান লালন–পালনের ক্ষেত্রে যে কারও টুকটাক ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এগুলোকে সহজভাবে মেনে নিন। তবে সন্তানকে ভালোবাসা দিন শতভাগ। তাকে সুস্থভাবে বড় করে তোলার চেষ্টা করুন। বুঝতে শুরু করলে ওর কোমল মনেই মানবতার বীজ বুনে দিন। আপনার সন্তান একজন ভালো মানুষ হবে, এই ভাবনা নিয়েই লালন–পালন করুন।
অতিরিক্ত চিন্তা নয়
শিশুকে নিয়ে অতিরিক্ত ভাববেন না, অবাস্তব প্রত্যাশা চাপিয়েও দেবেন না। পড়ালেখা, খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজ—সবই করুক শিশু। তবে কোনোটিই যেন চাপ হয়ে না দাঁড়ায় আপনার কিংবা তার ওপর। কোনো কাজে সেরা হওয়া অত জরুরি কোনো বিষয় নয়। কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ হলো, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। শিশু পড়ালেখার মূল বিষয় বুঝতে পারছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখুন। সব সময় মনে রাখবেন, সুস্থ একটি সন্তানের অভিভাবক হতে পারাই জীবনে কৃতজ্ঞ থাকার বিশাল এক কারণ। দুর্ঘটনা নিয়ে অহেতুক ভয় করবেন না। আপনার ভয় আপনার সন্তানকে বাঁচাবে না, তাকে বরং সতর্ক হতে শেখান।
সন্তানের সঙ্গে আপনিও বেড়ে উঠুন
সন্তান যেমন বড় হচ্ছে, আপনারও তো বয়স বাড়ছে। তার সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটান। আজকের দিনটা কিন্তু আর কখনোই ফিরে আসবে না। অভিভাবক হিসেবে একটা দিনও নষ্ট হতে দেবেন না। শিশুর সঙ্গে বসে রোজ অন্তত একটা বেলা খান। আপনার রোজকার কিছু কাজে তাকে সঙ্গে নিন। তার সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ করুন। যেকোনো পরিস্থিতিতে তার সঙ্গে মনের বন্ধনটা অটুট রাখুন। এভাবে মানসিক চাপ কমে যাবে অনেকটাই। আর শিশুও যেকোনো সমস্যার কথা আপনাকেই মন খুলে বলতে পারবে। আপনার অগোচরে কোথায় আপনার সন্তানের সঙ্গে কী হলো, তা নিয়ে দুশ্চিন্তাও কমবে।
নিজের যত্ন নিন
নিজের পুষ্টি, ঘুম, শরীরচর্চা ও অবসরযাপনের প্রতি মনোযোগী হোন। ভাববেন না যে এসবের কারণে আপনার সন্তান বঞ্চিত হচ্ছে; বরং সন্তানের ভালো থাকার জন্যই আপনার সুস্থতা জরুরি। তা ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে আপনি সন্তানকেও সঙ্গে নিতে পারেন। সন্তানের যত্ন–আত্তির কাজ মা–বাবা দুজনে ভাগ করে নিন। প্রয়োজনে নিজের মা–বাবা ও শ্বশুর–শাশুড়ির সহায়তা নিন। তাঁদের অভিভাবকত্বের ধরনটা আলাদা হলেও এতে আপনার চাপ কমবে।
মনের খেয়াল রাখুন
নিজের ভালো লাগার কাজগুলোকে একেবারে হারিয়ে যেতে দেবেন না। কিছুটা সময় রাখুন নিজের মনের জন্য। শিথিলায়ন করতে পারেন। ধ্যান ও যোগব্যায়াম দারুণ কাজে আসে। চাপ অনুভব করলে অভিভাবকত্ব নিয়ে যাঁরা আপনার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ (এবং অবশ্যই আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী), তাঁদের সহায়তা নিতে পারেন। তাঁদের ছোট ছোট পরামর্শে আপনার দায়িত্বপালন সহজ হতে পারে। প্রয়োজনে চাপ সামলাতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।