বিছানায় শুতে গেলে দম বন্ধ হয়ে যায়, বুক চেপে আসে ও হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়! এমনটা কারও কারও হয়। সারা দিন তেমন কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু রাতে বিছানায় মাথা দিলেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা। কেন এমন হয়?
রাতে শ্বাসকষ্ট হওয়ার কারণ
১. হৃদ্যন্ত্রের জটিলতা (হার্ট ফেইলিউর): হৃদ্যন্ত্রের জটিলতা রাতে শ্বাসকষ্টের অন্যতম প্রধান কারণ। হৃদ্যন্ত্র পর্যাপ্ত কর্মক্ষম না হলে শরীরে যথাযথ পরিমাণে রক্ত প্রবাহিত করতে পারে না; এ কারণে রাতে শোয়ার পর ফুসফুসে কিছু তরল জমা হতে পারে। এটিও শ্বাসকষ্টের অন্যতম কারণ। হার্ট ফেইলিউরের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট ও কাশির সঙ্গে পা ফোলাও থাকতে পারে।
২. অ্যাজমা (হাঁপানি): যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে হাঁপানির সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে মধ্যরাত অথবা ভোররাতের দিকে শ্বাসকষ্টের প্রবণতা দেখা যায়। রাতে শ্বাসনালির মাংসপেশি সংকুচিত হওয়া এবং প্রদাহ বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়, যা থেকে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এ ছাড়া রাতের বেলা যদি ঘরে তাপমাত্রা কিছুটা কম থাকে, ঘরের পর্দা বা কার্পেটে ধুলাবালু থাকে, সেটিও হতে পারে শ্বাসকষ্টের কারণ। হাঁপানির ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি বুকে চাপ ভাব, কাশি থাকতে পারে। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগ, যেমন সিওপিডিতে রাতে শুয়ে শ্বাসনালিতে বাধা বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা যায়।
৩. স্লিপ অ্যাপনিয়া: বর্তমান বিশ্বে স্লিপ অ্যাপনিয়ার সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। শারীরিক স্থূলতার সঙ্গে এই রোগ সম্পর্কিত। ঘুমের সময় বারবার শ্বাসনালি সংকুচিত হয়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, যাতে করে শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। তাই শ্বাসকষ্ট অনুভূত হয়, ঘুমও বারবার ভেঙে যায়। স্লিপ অ্যাপনিয়ার উপসর্গ হলো উচ্চ স্বরে নাক ডাকার প্রবণতা, সারা দিন ঘুম ঘুম ভাব, সকালে মাথাব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা।
৪. অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD): অ্যাসিডিটি হতে পারে রাতে শ্বাসকষ্টের অন্যতম কারণ। অ্যাসিড রিফ্লাক্সের কারণে খাদ্যনালি থেকে অ্যাসিড উঠে আসে, যা আমাদের শ্বাসনালিকে প্রভাবিত করে। এতে রাতে শোবার পরপরই শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি রোগীর আরও উপসর্গ থাকতে পারে। যেমন পেটে জ্বালাপোড়া, পেটে ফাঁপা ভাব, অতিরিক্ত ঢেকুর।
৫. স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজনের কারণে ফুসফুসের ওপর চাপ পড়ে। শুয়ে থাকার সময় এই চাপ আরও বেড়ে গিয়ে শ্বাসকষ্টের সৃষ্টি হয়।
৬. আবহাওয়া ও অ্যালার্জি: ঘরে থাকা ধুলা, পশুর লোম, ফুলের রেণু, ঠান্ডা আবহাওয়া বা কোনো অ্যালার্জেন রাতে ফুসফুসের সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে শ্বাসকষ্ট তৈরি করতে পারে।
৭. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ: অতিরিক্ত মানসিক চাপ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ডিপ্রেশন, আ্যাংজাইটির কারণেও রাতে শ্বাসকষ্টের মতো অনুভূতি হতে পারে।
করণীয়
ঘুমের অবস্থান পরিবর্তন: চিত হয়ে না শুয়ে পাশ ফিরে শোয়া বা মাথার দিকটা একটু উঁচু করে শোয়া শ্বাসকষ্ট কমাতে সাহায্য করতে পারে। অতিরিক্ত বালিশ ব্যবহার করে বা বিছানার মাথার দিকটা কিছুটা উঁচু করে এই অবস্থান তৈরি করা যায়। অ্যাসিড রিফ্লাক্সের কারণে শ্বাসকষ্টের সমস্যা এভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ঘরের পরিবেশ: শোয়ার ঘর ধুলাবালু মুক্ত রাখুন। নিয়মিত বিছানার চাদর, বালিশের কভার পরিষ্কার করুন। কার্পেট বা ভারী পর্দা ব্যবহার না করাই ভালো, কারণ, এগুলোতে ধুলা জমে শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়াতে পারে। বিশেষ করে হাঁপানির সমস্যা আছে যাঁদের, তাঁদের পদক্ষেপটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যালার্জেন এড়িয়ে চলা: যদি কোনো নির্দিষ্ট অ্যালার্জির কারণে শ্বাসকষ্ট হয়, তবে সেই অ্যালার্জেন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করতে পারেন।
ধূমপান পরিহার: ধূমপান শ্বাসনালির জন্য ক্ষতিকর ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়াতে পারে। তাই ধূমপান সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করা উচিত।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: রাতের খাবার হালকা হওয়া উচিত এবং ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত দুই থেকে তিন ঘণ্টা আগে খাওয়া উচিত। অতিরিক্ত তেল–মসলাযুক্ত খাবার বা অ্যাসিডিক খাবার রাতে এড়িয়ে চলুন।
নিয়মিত ব্যায়াম: হালকা ব্যায়াম করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, তবে ঘুমের ঠিক আগে ভারী ব্যায়াম করা উচিত নয়।
ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন কমাতে পারলে শ্বাসকষ্টের সমস্যা অনেকাংশে কমে যায়। সুষম আহার ও নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
মানসিক চাপ কমানো: যোগ, মেডিটেশন বা পছন্দের শখের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন। রাতে ঘুমানোর আগে হালকা গরম পানিতে গোসল করলে বা ভালো বই পড়লে মন শান্ত হয়।
রোগ নিয়ন্ত্রণ: যদি অ্যাজমা, হার্ট ফেইলিউর বা অন্য কোনো রোগের কারণে শ্বাসকষ্ট হয়, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ ও নিয়মিত ফলোআপে থাকা প্রয়োজন।
রাতে শ্বাসকষ্টের সমস্যা অবহেলা করা উচিত নয়। এটি গুরুতর কোনো স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। তাই এই সমস্যা হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং ওপরে দেওয়া জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করে সুস্থ থাকুন।
শ্বাসকষ্ট বুক