সচিবালয়ে কর্মচারীদের বিক্ষোভ, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মচারীদের কর্মবিরতি, বিভিন্ন ক্যাডার কর্মকর্তাদের ‘কলম বিরতি’–এভাবেই সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার কর্মীরা নানাবিধ দাবিতে গত কিছুদিন ধরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে আসছেন।
এগুলোর মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে অন্তর্বর্তী সরকারকে পরিকল্পনা থেকে সরেও আসতে হয়েছে।
যেমন গত ১২ মে ‘রাজস্ব নীতি ও প্রশাসন সংস্কার অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করা হয়, পরে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভের মুখে ২৫ মে রোববার অর্থ মন্ত্রণালয় ওই অধ্যাদেশের সংশোধনের আশ্বাস দিলে রাজস্ব বোর্ডের কর্মীরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নেন। খবর বিবিসি বাংলার।
একইভাবে, গত কয়েকদিন ধরে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রত্যাহারের দাবিতে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিক্ষোভ করেন। পরে বুধবার সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার সময় ঠিক করা হলে একদিনের জন্য বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করেন বিক্ষোভকারীরা।
এছাড়া প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ‘বৈষম্যমূলকভাবে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলার’ প্রতিবাদে সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কলম বিরতি কর্মসূচি পালিত হয় মঙ্গলবার। বুধবারও সারা দেশে একই সময়ে তাদের কলমবিরতি কর্মসূচি চলবে বলে জানানো হয়েছে।
এমন অবস্থায় বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভের মতো কর্মসূচির কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানোর ক্ষেত্রেই সরকার চাপের মুখে পড়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
সরকারের জন্য কিছুটা হলেও চাপ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। এরকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার শঙ্কাও দেখছেন তারা।
এমন প্রেক্ষাপটে সরকার কতটা সুষ্ঠুভাবে তাদের নিয়মিত কার্যক্রম চালাতে পারবে, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।
যদিও কর্মচারীদের আন্দোলর বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানাতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, তারা আশা করছেন প্রজাতন্ত্রের যারা কর্মচারী তারা প্রজাতন্ত্রের নিয়ম কানুন মেনে চলবেন।
সমস্যা ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতির’
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন সরকারের আমলাদের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বোঝাপড়ার ঘাটতি থাকার কারণে দুপক্ষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, যার ফলে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এমন বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন। আর এই আস্থার সংকট তৈরি হওয়ার পেছনে বাংলাদেশের ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ দায়ী বলে বলছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ছায়েদুর রহমান।
তিনি বলছেন, আমলাতন্ত্র নিরপেক্ষ হওয়ার কথা থাকলেও আমাদের দেশের আমলারা কিন্তু কখনোই নিরপেক্ষ ছিলেন না– সেই বৃটিশ আমল থেকেই। তারা সবসময়ই রাজনৈতিকভাবে কিছুটা প্রভাবিত থাকেন। তাই গত আগস্টে দেশে যখন হঠাৎ করে ক্ষমতার একটা পরিবর্তন হয়েছে, তখন দুপক্ষের মধ্যেই বোঝাপড়ার একটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
তার মতে, রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলে সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে এই বোঝাপড়া থাকে এবং দুপক্ষের মধ্যে নীতিগত দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও কম থাকে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সংশ্লিষ্টতা?
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোববার মন্তব্য করেন যে বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আছে এবং আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের পর তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও কেউ কেউ মনে করেন, গত কিছুদিন বিভিন্ন বিভাগের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিক্ষোভের পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর উসকানি থাকতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদের ভাষ্য, গত কিছুদিনে সরকারের বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হওয়া বিক্ষোভে জুলাই অভ্যুত্থানের ‘বিজয়ী ও পরাজিত শক্তি’ দুপক্ষেরই সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে।
তার মতে, নানাবিধ বাধার মুখে সরকারের পুরো সংষ্কার পরিকল্পনাই মাঠে মারা যাওয়ার মতো অবস্থা। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের পক্ষে না কারণ সংস্কার হলে তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থেও আঘাত লাগবে। কাজেই বিভিন্ন জায়গায় যে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে, তার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বিজয়ী ও পরাজিত, উভয় দলেরই সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে।
লোক প্রশাসনের অধ্যাপক ছায়েদুর রহমান বলছিলেন, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে এই ধরনের অস্থিরতা আরো দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারতো। কারণ তখন সব পক্ষেই রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের প্রভাব থাকতো।
সংকট ঘনীভূত হতে পারে?
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা সামনে আসতে শুরু করেন। পদোন্নতি-পদায়নের দাবিতে অনেকে বিক্ষোভ করেন, এমনকি বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে হাতাহাতির মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে।
একই সঙ্গে, শেখ হাসিনার সরকারের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তাদের সরিয়ে সেখানে নতুন মুখ আনতেও দেখা গেছে। মাসখানেক ধরে প্রশাসনে অস্থিরতা দেখা গেছে ওই সময়। এখন আবার সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারের সংস্থাগুলোতে এ ধরনের অস্থিরতা চলতে থাকলে সংকট আরও তীব্র মাত্রা ধারণ করতে পারে।
লোক প্রশাসনের অধ্যাপক ছায়েদুর রহমান বলছিলেন, যে কোনো ইস্যুতে দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন বা বিক্ষোভের ধারা চলমান থাকাও দীর্ঘমেয়াদে সরকারের জন্য ক্ষতিকর হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদও বলছিলেন, এক পক্ষ যখন দেখবে আন্দোলন করলেই কিছু পাওয়া যায়, তখন আরেক পক্ষও উদ্বুদ্ধ হবে আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে। এটা বাড়তেই থাকবে।
বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারীদের আন্দোলর বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে মঙ্গলবার বিকালে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবিষয়ে সরকারের অবস্থান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। সরকারি তাদের (সরকারি চাকরিজীবীদের) কোনো চাওয়া থাকে তা আমাদের সচিবরা আছেন, সচিবদের ছোটো কমিটিও আছে, তাদেরকে বলতে পারেন। আমরা মনে করি প্রজাতন্ত্রের যারা কর্মচারী তারা প্রজাতন্ত্রের নিয়ম কানুন মেনে চলবেন।
সূত্র: যুগান্তর
অন্তর্বর্তী সরকার সচিবালয় আন্দোলন প্রশাসন