ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নের নাটাই গ্রামে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শতাধিক ঘর, চলছে লুটপাট। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নারী-পুরুষসহ শিশুরাও। এ গ্রামে এমন অরাজকতা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিরাজ করছে।
এর আগে কয়েক দিন গ্রামের দুই গোষ্ঠীর লোকদের বিরোধে সংঘর্ষ চলেছে। বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট ছাড়াও সে সময় হতাহতের ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বাগে আনতে ব্যর্থ হয় এই দাঙ্গাবাজদের। গত এক মাসের বেশি সময় ধরে গ্রামটিতে নেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
ঘরবাড়িতে দেওয়া আগুনে সর্বস্ব হারিয়েছেন নাটাই গ্রামের অনেক পরিবার। বাড়ির নাম সুখের নীড়। সেই নীড়ে এখন আগুনে পোড়া ধ্বংসাবশেষ। বাকপ্রতিবন্ধী শাহজাহান মিয়ার চার মেয়ে স্বপ্নের দালান ঘরে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়েছে সব, লুটপাট চালানো হয়। বাড়িতে ফিরতে পারছেন না চার বোন আকলিমা, মোসলেমা, তানিয়া ও খাদিজাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। পুত্রহীন শাহজাহান মিয়ার মৃত্যুর পর ৪ মেয়ে তাদের কষ্টার্জিত অর্থে দালান করার স্বপ্ন বুনেন। তাতে সহায়তা করেন বিবাহিত বোনদের স্বামীরা।
২০২৩ সালে ৪ শতাংশ জায়গার অর্ধেকের বেশিতে চারতলা ফাউন্ডেশনের বাড়ি করার কাজ শুরু হয়। ২০২৪ সালে একতলা সম্পন্ন হয়। ওই বাড়িতেই বসবাস ছিলো শাহজাহান মিয়ার স্ত্রী ও ৩ মেয়ে। আরেক মেয়ে তানিয়া আক্তার স্বামীর বাড়িতে থাকেন। বড় বোন আকলিমার স্বামী প্রবাসী। স্বামী সন্তানসহ ওই বাড়িতেই বসবাস তার।
আকলিমা বলেন, আমরা সুখেই ছিলাম। এক বোন মুসলেমা আক্তার দর্জির কাজ করেন। ছোট বোন খাদিজা আক্তার উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করেন। দুটো সেলাই মেশিন ও অনেক কাপড় ছিল। সব লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এরপর দুটি রুমে আগুন দিয়ে সবকিছু পুড়িয়ে দিয়েছে। সবাই মিলে ৩০ লাখ টাকা খরচ করে বাড়িটি করেছিলাম।
তিনি বলেন, ঘটনার সময় আমি শহরের মেড্ডায় ছিলাম। খবর পেয়ে বাড়িতে গেলেও ঘরে ঢুকতে পারিনি। পালিয়ে চলে আসি। ঘরে আগুন আর লুটপাটে সর্বস্ব হারিয়েছেন নাটাই গ্রামের আরও অনেক পরিবার।
নাটাই পূর্বপাড়ার মজিবুর রহমানে স্ত্রী শরীফা বেগম (৫০) জানান, তার বাড়িতে প্রথম আগুন দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ২টি ঘর। মৃত্যুর ঘটনার পরপরই তার বাড়িতে হামলা হয়। সে সময় তাকে এবং তার বড় ছেলে মাসুদের স্ত্রী ইভা, ভাইঝি ও ২ নাতি-নাতনিকে হামলাকারীরা মারধর করে। ইভাকে মাথায় আঘাত করে এবং গলা থেকে চেইন, কান ছিঁড়ে দুল নিয়ে যায়। পরে বারান্দার রুমে বসিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারার হুমকি দেয়। এরপরই তারা পেছনের দরজা খুলে দৌড়ে পালান।
শরীফা বলেন, ভয়ে বাড়িতে যাই না। গেলেই এরা আসে। নাতি-নাতনিরা মারধরের ভয়ে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।
ছলিম বাড়ির হাফসা আক্তার জানান, ১৪ মে (বুধবার) দুপুরে বাসার ভেতরে ছিলাম। খেতে বসবো এ সময়ে অজস্র লোকের ছুটে আসার শব্দ পাই। তারা আমাদের গেটে হামলা করে। অবস্থা খারাপ দেখে সন্ধ্যায় এক কাপড়ে বাড়ি থেকে সরে পড়ি। এরপর রাত ১০টার দিকে আমাদের বাড়িতে ঢুকে হামলা, লুটপাট করা হয়। রাত ৩টার দিকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মোট ৪বার আগুন দেওয়া হয়। সর্বশেষ ১৫ মে সকাল ১০ টার দিকে দেওয়া আগুনে আমার বিল্ডিংসহ সবকিছু শেষ হয়ে যায়। আমার ক্ষতি ১ কোটি টাকার ওপরে।
ছলিম বাড়ির মোহাম্মদ আলীর বাড়ি ছাড়াও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুল্লাহ বাহার, গ্রামের পূর্ব পাড়া, মধ্যপাড়া ও পশ্চিম পাড়ার মামুন মিয়া, আরিজ মাহমুদ,আব্দুস সালাম, জামাল মিয়া, চান্দু মিয়া, ফারুক মিয়া, আউলাদ হোসেন, জাকির হোসেন, আলি হোসেন, ইকবাল হোসেন, আলকাছ মিয়া, শফিক মিয়া, মতি মিয়া, মনির মিয়া, আক্তার হোসেন, হানিফ মিয়া, জিলন মিয়া, আনোয়ার হোসেন, সুমন মিয়া, মিলন মিয়া, লিটন মিয়া, ইয়াছিন মিয়া, আবু বক্কর, মিজান মিয়া, কামাল মিয়া ও মোহাম্মদ মিয়া, মাসুদ মিয়া, বিল্লাল মিয়া, কামরুল মিয়া, প্রতিবন্ধী মালু মিয়া, জামাল মিয়া, জারু মিয়া, বারু মিয়া, আবু জামাল, জুলহাস মিয়া, আবু কালাম, হেলাল মিয়া, জজ মিয়ার বাড়িসহ আরও অনেক বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট শেষে আগুন দেওয়া হয়। এসব বাড়ির অনেকের ক্ষতি কোটি টাকার নিচে নয় বলে জানান ক্ষতিগ্রস্তরা। হামলার সময় অনেক নারী ও শিশুকে মারধর করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদক সেবনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামের ছলিম ও চান্দের গোষ্ঠীর লোকজনের সাম্প্রতিক বিরোধ হলেও ঘটনার নানা ডালপালায় বিগত ৩ মাস ধরে অশান্ত এই গ্রাম। পালটাপালটি একপক্ষ, আরেকপক্ষের লোকজনকে মারধর করা নিয়ে বিস্তৃত হয় ঘটনা।
৩১ মার্চ ছলিমের গোষ্ঠির তানিম নামে একজনকে মারধর করে চান্দের গোষ্ঠীর লোকজন। এ ঘটনায় ৪ এপ্রিল তানিমের বাবা শাহেদ মিয়া বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। পালটা চান্দের গোষ্ঠীর তুহিনকে মারধর করা হয়।
জবাবে ১২ মে ছলিমের গোষ্ঠীর আনোয়ার নামে একজনকে মারধর করা হয়। এ ঘটনায় ৩৮ জনকে আসামি করে মামলা দেওয়া হয়। এরপর চান্দের গোষ্ঠীর তকদীর মেম্বারের ছেলে দীপুকে মারধর ছলিমের গোষ্ঠীর লোকজন। মারধরের সর্বশেষ এ ঘটনার পরই উত্তেজনা তুঙ্গে উঠে। ৩ দিন ধরে টেঁটা-বল্লম নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে। গত ১৪ মে সংঘর্ষ চলাকালে মিয়াজুল হোসেন (৪৫) নামে একজন মারা যান। এরপরই নির্বিচারে প্রতিপক্ষের ঘরবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট শেষে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, দুই গোষ্ঠীর বিরোধ মেটাতে আশপাশের এলাকার সর্দার মাতব্বর এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা উদ্যোগ নিলেও তা ব্যর্থ হয়।
এ বিষয়ে কথা বলতে কাজী মোবারক হোসেনের নাম্বারে বারবার ফোন করে বন্ধ পাওয়া যায়। এ গোষ্ঠীর আরেক নেতা চান মিয়া বলেন, এখন শান্ত আছে। বাবা (ইয়াবা) নিয়ে ঘটনা। একদল বাবা খাওয়ার পক্ষে, আরেকদল ফেরানোর পক্ষে। কিছু ভাঙচুর হয়েছে। কতো ঘরবাড়ি তা আমি দেখিনি। ভাঙচুর ও লুটপাটের সঙ্গে বাইরের সুযোগ সন্ধানীরাও জড়িত।
মিয়াজুলের মৃত্যুর ঘটনায় ১৭ মে তার ছোট ভাই শাহাজুল বাদী হয়ে হত্যা মামলায় ১২৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
শাহাজুল হোসেন বলেন, গত রমজানের ঈদের দিন থেকে ঘটনার সৃষ্টি। ছলিমের বাড়ির সাহেদ মিয়ার ছেলেরা ১ কিলোমিটার দূর থেকে আমাদের বাড়ির কাছে মাদক সেবন করতে এলে আমাদের ছেলে ভাতিজারা বাধা দেয়। এটি কেন্দ্র করে আমার এক ভাতিজাকে শহরের টেংকেরপাড়ে মারধর করে। আমার ভাইরে মারধর করে হাত-পা ভেঙে ফেলেছে। এটাকে শেষ করার জন্য আমার ভাই মিয়াজুল এমন কোনো সর্দার নেই যে যায়নি। বিএনপি ও হেফাজত নেতাদের কাছে গেছে। তারা কোনো সমাধান আনতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত পীরবাড়ি থেকে বাড়িতে আসার পথে বল্লম দিয়ে ঘাই মেরে আমার ভাইকে মেরে ফেলছে। হেরার বাড়িঘর হেরাই আগুন দিয়ে পুড়ায়া আমাদের দোষ দিছে।
সদর মডেল থানার ওসি মোজাফফর হোসেন জানান, নাটাইয়ের ঘটনায় পক্ষে-বিপক্ষে ৩টি মামলা হয়েছে। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ টহল দিচ্ছে। হত্যা মামলায় ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
নাটাই উত্তর ইউনিয়নের প্রশাসক উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা সরেজমিন দেখে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ করছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত ইশতিয়াক ভূইয়া বলেন, সেখানে প্রশাসক রয়েছেন। তাদের দুইপক্ষের ক্ষতি নিরূপণ করতে বলা হয়েছে।