বাজেটে ঘাটতি ও ভর্তুকির চাপ কমিয়ে আনা, কাঠামো, ব্যাংক, শেয়ারবাজারসহ সামগ্রিক আর্থিক খাত সংস্কারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চাপ দিয়ে আসছিল অনেক আগে থেকেই। এ ছাড়া, অনিয়ম-দুর্নীতি কমিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বিভক্ত করার পরামর্শও আইএমএফেরই। রিজার্ভ গণনার নতুন পদ্ধতি চালু করা এবং ডলারের দরের ওপর থেকে ক্যাপ তুলে দিয়ে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করতে হয়েছে আইএমএফের চাহিদা মতোই।
অন্যথায় সংস্থাটির সঙ্গে চলমান ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রকল্পের কিস্তি আটকে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নেওয়া এ প্রকল্প চলমান রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর বাইরে আরও অনেক সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যার পুরো প্রতিফলন ঘটতে যাচ্ছে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে।
অবশ্য চলতি বাজেটেও এর প্রতিফলন ঘটেছিল। এজন্য ২০২৪-২৫ বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে নতুন ২০২৫-২৬ বাজেটের আকার ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা ধরা হচ্ছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এই প্রথম বাজেটের আকার আগের অর্থবছরের তুলনায় কমিয়ে ধরা হচ্ছে। যেখানে চলতি বাজেটের আকার ধরা হয়েছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থবিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে অর্থবিভাগের একটি সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে কমানো হবে ১৩৫ পণ্যের শুল্ক। এতে এসব পণ্যের দাম কিছুটা কমবে। তবে পাশাপাশি আইএমএফের পরামর্শে ৩১টি শিল্পের কর অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহার এবং আইটি ব্যবসার আয়কে করের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত সরকারি গেজেটভুক্তদেরও আয়করে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হতে পারে আগামী বাজেটে।
সূত্রমতে, এ বছর বিশেষ এক সময়ের নতুন বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংসদ কার্যকর না থাকায় যা বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারের মাধ্যমে জাতির সামনে বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বাজেটে অগ্রাধিকার পাচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। প্রবৃদ্ধি অর্জন নয় বরং কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা থাকছে নতুন বাজেটে। ঘাটতি কমাতে ছোট করা হচ্ছে বাজেটের আকার। এমনিতেই এনবিআরের ওপর অনেক চাপ রয়েছে। এ ছাড়া এনবিআরকে বিলুপ্ত করে নতুন দুটি বিভাগ চালুর অধ্যাদেশ জারি করায় অব্যাহতভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন বোর্ডের কর্মীরা। এত সব চাপ নিয়ে নতুন একটি অর্থবছর শুরু হতে যাচ্ছে পয়লা জুলাই থেকে।
এনবিআর সূত্র জানায়, সাধারণ ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে। আগামী বাজেটে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো জুলাইযোদ্ধাদের আয়কর সীমায় ছাড় দিতে যাচ্ছে এনবিআর। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের আয়ের জন্য এ সীমা প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ, ২০২৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়ের ওপর নতুন সীমা অনুযায়ী কর নির্ধারণ করা হবে। জানা গেছে, ৪ দশমিক ৭ ঋণ প্রকল্পের বিপরীতে আইএমএফের শর্ত মোতাবেক রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে শুল্ক ও কর কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিয়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।
এর ফলে কিছু খাতে নতুনভাবে করের বোঝা বাড়তে পারে, আবার কিছু খাতে মিলতে পারে স্বস্তি। তবে যেসব খাতে কর বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষের কাঁধে নতুনভাবে করের বোঝা বাড়বে। যার চূড়ান্ত ফল হিসেবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে বলে মনে করেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে জন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে নির্বাচন আয়োজনের খরচ মেটানোর জন্য প্রায় ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনে এ অর্থ ব্যয় করবে নির্বাচন কমিশন।
এছাড়া এ সময়ে সিটি করপোরেশন, উপজেলা-জেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ, উপনির্বাচনসহ অন্তত আড়াই হাজার নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হবে উল্লেখ করে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ৫ হাজার ৯২১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল নির্বাচন কমিশন। এর আগে ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ওই অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। যদিও সে বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ব্যয় সংকুলান করতে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৪ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, সার্বিকভাবে বাজেটের আকার ছোট হলেও সরকারি ব্যয়ের সুদ পরিশোধ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় বরাদ্দ প্রায় ১১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকায়। যা মোট বাজেটের প্রায় ২৮ শতাংশ। এদিকে সুদ পরিশোধের পরই পরিচালনা বাজেটের অন্যতম বড় খাত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা। চলতি বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ৮২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৬ শতাংশ বাড়িয়ে নতুন বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এর অন্যতম কারণ হলো, প্রথম থেকে নবম গ্রেডের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১৫ শতাংশ এবং দশম থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আগামী ১ জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা এ সুবিধা পেতে পারেন। এজন্য বাড়তি প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে।
অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আর্থিক সংকটের কারণে এবারের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে অপ্রয়োজনীয় ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্পগুলো বাদ দেওয়া হচ্ছে। ফলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ কমিয়ে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে চলতি অর্থবছরের এডিপি ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এনবিআরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি বছরের মূল লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার চেয়ে ৩৮ হাজার কোটি টাকা বেশি। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগ বলছে, অভ্যন্তরীণ ঋণ, বিশেষ করে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের ওপর চাপ কমাতে ঘাটতির এ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি অর্থ বিদেশি উৎস এবং বাকিটা দেশি উৎস থেকে সংগ্রহ করার পরিকল্পনা রয়েছে। নতুন এ বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ এবং মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এ দুই সূচকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ও ৬ শতাংশ। তবে সংশোধিত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ এবং মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন