রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকলে বিনিয়োগে স্থবিরতা কাটবে না বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। গণমাধ্যমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, নতুন বাজেটের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি। প্রবৃদ্ধি কম হবে, সেটা মেনে নিতে হবে।
প্রশ্ন: সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর অবস্থা কী?
উত্তর: সরকার পতনের পর সামষ্টিক অর্থনীতির প্রায় সব কটি সূচকই নেতিবাচক ছিল। তখন থেকে কিছু কিছু সূচকে উন্নতি হচ্ছে, যদিও সেটা ধীরগতিতে। মূল্যস্ফীতির হার এখনো বেশি। কর-জিডিপির হার কম।
দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগ কম। জ্বালানির দাম অনেক বেশি। নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে। বিদেশি ঋণের দায়দেনা বেশি।
গত ৯ মাসে মূল্যস্ফীতির হার সামান্য হলেও কমছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনমুখী ধারা থামানো গেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি এ বছর এবং আগামী বছর কম হবে। আগে তথ্যের গোঁজামিল ছিল।
জুলাই-আগস্ট মাসের আগে-পরে রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ একেবারেই হচ্ছে না। উচ্চ সুদহার ও জ্বালানির উচ্চমূল্য উদ্যোক্তাদের চাপের মধ্যে রেখেছে। ব্যবসায়ীদের উৎপাদন খরচ অনেকখানি বেড়ে গেছে। অর্থনৈতিক সূচকগুলোর পতন থামানো এবং অর্জনগুলোকে সংহত করার একটা প্রক্রিয়া চলছে।
কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে কেউ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে না। এতে দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানতে নীতিসুদ হার বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে। যাঁরা ব্যবসা করছেন, উৎপাদন বাড়াচ্ছেন, তাঁদের বেশি খরচে ঋণ নিতে হচ্ছে।
প্রশ্ন: গতানুগতিক বাজেট দিয়ে এই সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যাবে কি?
উত্তর: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা নতুন বাজেটের মূল লক্ষ্য। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরকারি ব্যয় যদি কমে যায় তাহলে আরো কর্মসংস্থান কমে যাবে। বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বেকারত্বের হার বাড়ছে। বিনিয়োগ না হলে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড না বাড়লে প্রবৃদ্ধিও হবে না। ব্যয়ের চাহিদা অনেকখানি আছে। সরকারের প্রশাসনিক ব্যয়ও কম নয়। মানুষের অনেক প্রত্যাশা আছে। ভৌত অবকাঠামো, জ্বালানি, কৃষি, শিল্প—সব জায়গায় চাহিদা রয়েছে। কিন্তু ব্যয়টা মেটাতে হলে রাজস্ব আয় প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের যে রাজস্ব আয় হচ্ছে, তা অনেক কম। আমাদের কর জিডিপি হার এখনো ৮ শতাংশের নিচে। কম আয় দিয়ে বিপুল ব্যয়ের চাহিদা মেটানো আমাদের বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ।
বাজেট বাস্তবায়নে প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?
ড. ফাহমিদা খাতুন: আগে ভৌত অবকাঠামোয় বেশি নজর দিতে গিয়ে সামাজিক অবকাঠামো অবজ্ঞা করা হয়েছে। বরাদ্দ ব্যবস্থাপনাও বাজেটের চ্যালেঞ্জ। একদিকে টাকার অভাব, অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে ব্যালান্স করে খরচ করতে হবে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বজায় আছে, কিন্তু সরকারের খরচ যদি বেড়ে যায় তখন এই মুদ্রানীতি কাজ করবে না। তখন আর মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি—এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে হবে।
এনবিআর বিভক্ত করার কারণে রাজস্ব আদায়ে ঝুঁকি আছে কি না?
ড. ফাহমিদা খাতুন: অবশ্যই। এখন পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের যে ধারা দেখা গেছে, সেটা চলতে থাকলে একটা বিরাট ঘাটতি দেখা দেবে। গত মার্চ পর্যন্ত আমাদের যে রাজস্ব ঘাটতি দেখা দিয়েছে সেটা করোনার সময় ছাড়া গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আর এনবিআর কর্মকর্তাদের আন্দোলন চলার কারণে রাজস্ব আদায়ের ওপরও প্রভাব পড়ছে। এটা সার্বিক রাজস্ব আদায়ে তো প্রভাব পড়বেই।
আইএমএফের শর্ত মেনে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এসব পদক্ষেপ মানুষ ও স্থানীয় শিল্পের ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে?
ড. ফাহমিদা খাতুন: এরই মধ্যে দেশের ব্যবসার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ব্যবসায়ীসমাজ তাদের সমস্যার কথাগুলো বলছে। সুদের হার বৃদ্ধি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং দুর্নীতির কারণে ব্যবসার খরচ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। সেটার প্রভাব পুরো অর্থনীতিকে বহন করতে হবে। উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই আগামী বছর কিভাবে ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায় সে ধরনের পদক্ষেপের দিকে নজর দিতে হবে।
ব্যবসায়ীরা নতুন করে বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
ড. ফাহমিদা খাতুন: এই মুহূর্তে সুদের হারের দিকে হাত না দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু যেটা এখন চাইলে সরকার করতে পারে, সেটা হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করা। যেমন—আন্দোলনের কারণে রাস্তাঘাট বন্ধ থাকলে ব্যবসায়ীরা মালপত্র আনা-নেওয়া করতে পারেন না। এটা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নয়। তাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইন-শৃঙ্খলা উন্নত করা এখন সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিত।
নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেই কি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে?
ড. ফাহমিদা খাতুন : অনেকাংশেই। কারণ বিনিয়োগকারীরা স্বল্প সময়ের জন্য বিনিয়োগ করেন না। ব্যবসায় রিটার্ন আসতে পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লেগে যায়। তাই তাঁরা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখতে চান। যদিও বলা হচ্ছে যে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে; কিন্তু মানুষের মনে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। তারিখ ঘোষণা করলে একটা ধারণা আসে; যেটা ব্যবসা ও অর্থনৈতিক অবস্থার দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কর্মসংস্থান বাড়াতে বাজেটে কী ধরনের পদক্ষেপ থাকা দরকার?
ড. ফাহমিদা খাতুন: গতানুগতিক বাজেট দিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা মোটেই সম্ভব নয়। সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে কর্মসংস্থান করা যায় না। সে জন্য যে প্রকল্পগুলো আগে হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলো শেষ হলে আরো ভালো হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) কিছু প্রণোদনা দরকার। কারণ এখানে অনেক কর্মসংস্থান তৈরি হয়। এ ছাড়া কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। গ্রামে বিনিয়োগ করলে অনেক কর্মসংস্থান হয়। আর প্রযুক্তি খাতে নতুন উদ্যোক্তাদের (স্টার্টআপ) সহযোগিতা করা দরকার।
সরকারের সংস্কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে আপনার পরামর্শ কী?
ড. ফাহমিদা খাতুন: যেসব সংস্কার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে স্বল্পমেয়াদি সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এগুলো বাস্তবায়ন করে ফেলা উচিত। দারিদ্র্য বাড়া, কর্মসংস্থান কমা ও মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষের যে কষ্ট হচ্ছে, তাদের জীবন স্বাভাবিক বা স্মুথ করার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীটা বাড়ানো এবং খোলাবাজারে ওএমএসের কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন।
বাজেট