হজ ও কোরবানিতে মহান আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-এর আমল, রীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলেছেন। কেননা এসব আমল মানবজাতিকে মুখাপেক্ষী জীবন, অহঙ্কবোধ ও আত্মপূজা থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতার সেই সৌন্দর্যমণ্ডিত পোশাক পরিধান করায়। ইহরাম, বিরাণ প্রান্তে অবস্থান, প্রস্তর নিক্ষেপ, সায়ি ও তাওয়াফের সেসব আমল যা তিনি সম্পাদন করে থাকেন তা মূলত একত্ববাদের শিক্ষা দেয় এবং বাহ্যিক উপায়-উপকরণ অস্বীকার করে আল্লাহর ওপর আস্থা রাখতে শেখায়। তাঁর রাস্তায় কোরবানি, তাঁর আনুগত্য, অনুসরণ ও সন্তুষ্টিকে নিজের জীবনে কার্যকর করা, স্থায়িত্ব দান করা ও সক্রিয় করে তোলার একটি প্রচেষ্টা মাত্র। যা একই সঙ্গে আচার-অভ্যাস, রসম-রেওয়াজ, মিথ্যা মানদণ্ড ও কৃত্রিম মূল্যবোধের বিরুদ্ধে এক প্রকাশ্য বিদ্রোহ এবং শক্তিশালী ঈমান, সত্যিকার ভালোবাসা, দৃষ্টান্তহীন আত্মত্যাগ, সর্বোন্নত মানের আত্মোত্সর্গ ও স্বার্থলেশহীনতার সংস্কার ও নবায়ন।
হজ সেসব মহত্তম লক্ষ্য, বিশুদ্ধ আবেগ ও প্রেরণা, রুহানি ও ঈমানি মূল্যবোধ, অধিকন্তু সেসব মানবীয় ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের স্থায়িত্ব ও উন্নতির নিশ্চয়তা দেয় যা কৃত্রিম জাতীয়তা, বংশগোত্র ও ভূখণ্ডের সীমিত ও ত্রুটিপূর্ণ মাপকাঠির ঊর্ধ্বের। ইবরাহিম (আ.), তাঁর ইবাদত ও তাঁর চেষ্টা-সাধনা মানবতারূপ বইয়ের নতুন, আলোকোজ্জ্বল ও প্রোজ্জ্বল শিরোনাম। এর থেকে একটি ইতিহাস অন্য ইতিহাস থেকে আলাদা হয়ে যায়।
হজ ও হজ মৌসুমের যাবতীয় ইবাদত ও আচার এবং মিল্লাতে ইবরাহিমের সন্তানদের মক্কায় এই বার্ষিক সম্মেলন ও সমাবেশ ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর নাম উচ্চারণকারী রুহানি সন্তানদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সেসব অর্থ, আকিদা-বিশ্বাস ও উদ্দেশ্যের নবায়নের জন্য যথেষ্ট এবং এর ভেতর কেবল এই মিল্লাতের নয়; বরং সমগ্র মানবতার অস্তিত্ব নির্ভর করছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পবিত্র কাবা ঘর, পবিত্র মাস, কোরবানির জন্য কাবায় প্রেরিত পশু ও গলায় মালা পরিহিত পশুকে আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারিত করেছেন। এটা এজন্য যে, তোমরা যেন জানতে পারো যা কিছু আসমান ও জমিনে আছে আল্লাহ তা জানেন এবং আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞ।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৯৭)
ইসলাম ও নবুওয়াতে মুহাম্মদির যুগে এই ঘর হেদায়েত ও ইরশাদ, রুহানিয়্যাত ও লিল্লাহিয়্যাত, মনের খোরাক ও চিত্তের প্রশান্তির এক স্থায়ী কেন্দ্রে পরিণত হয়। যেখানে হজের নিয়মনীতি ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়, রুহ ও অন্তরের শক্তি ও খোরাক সরবারহ করা হয়। সমগ্র উম্মাহ এখান থেকে ধর্মীয় পয়গাম লাভ করে। গোটা মুসলিম জগত প্রত্যেক বছর এখানে একত্র হয়ে আপন ভালোবাসা, আনুগত্য, আত্মসমর্পণ ও আত্মনিবেদনের মূল্য আদায় করে। আল্লাহ তার এই মজবুত রশি ও সুদৃঢ় স্তম্ভের সঙ্গে নিজের গভীর সম্পর্কের প্রমাণ দেয়। পৃথিবীর বড় বড় মনীষী ও জ্ঞানী-গুণী, রাজা-বাদশাহ, ধনী-গরিব, রাজনীতিবিদ ও শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিরা প্রেম-ভালোবাসা ও আবেগ-উদ্দীপনার সঙ্গে এর তাওয়াফ করে।
হজ মুসলিম মিল্লাতের বার্ষিক সমাবেশ ও সম্মেলন। অন্য কথায় বার্ষিক প্যারেড মুসলিম জাতির সত্যবাদিতা, পবিত্রতা এবং তার আসল ও প্রকৃত বুনিয়াদের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যার গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে। এই দীনকে বিকৃতি, অস্পষ্টতা ও ভেজালের হাত থেকে নিরাপদ রাখা, এই উম্মাহকে তার প্রকৃত উত্স ও আপন মূলের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখা এবং সেসব ষড়যন্ত্র ও বিভ্রান্তির পর্দা উন্মোচনে এই সমাবেশ ও সম্মেলন থেকে যে সাহায্য পাওয়া যায় তা অন্য কিছু থেকে পাওয়া যায় না।
তামিরে হায়াত থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর