মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ পরিবেশ দূষণ। এর জন্য মানুষের কৃতকর্ম অনেকাংশে দায়ী। মানবসমাজে ইসলামী নির্দেশনার বাস্তবায়ন নানাভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধ করতে পারে। কারণ ইসলামে আছে—ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার, বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, জীব-জন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা পরিহার এবং পানি ও বায়ু দূষণ মুক্ত রাখার নির্দেশনাসহ আরো অনেক নীতিমালা। এসবের মাধ্যমে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ সহনীয় হয়, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমে যায় এবং পরিচ্ছন্ন পানি ও বাতাস প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।
বিস্তারিত নিম্নরূপ—
(১) ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার : ভূমির যথাযথ ও পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত হলে পরিবেশের ভারসাম্য সহজেই ফিরে আসবে। এজন্য কৃষি জমিতে চাষাবাদ ও বনায়ন করতে হবে। নিজে আবাদ করতে না পারলে অন্যকে বর্গা অথবা এমনিতেই আবাদ করতে দিতে হবে। অকৃষি জমিতে ঘর-বাড়ি, খামার, বাণিজ্যিক অথবা অবাণিজ্যিক স্থাপনা অথবা অন্য কোনভাবে ব্যবহার করতে হবে। বাড়ির আশেপাশের খালি জায়গা, বাড়ির ছাদ, বাড়ি নির্মাণের জন্য বরাদ্দ পাওয়া ফাঁকা প্লট এবং নিজ নিজ মালিকানাধীন জায়গা-জমির যথার্থ ব্যবহার হলে জাতির অবস্থা কখনোই শোচনীয় হবে না। জমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হাদিসে বারবার বলা হয়েছে। জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার কাছে জমি আছে সে যেন তা (নিজে) চাষাবাদ করে। যদি সে (নিজে) চাষাবাদ না করে তবে যেন তার কোন ভাইকে চাষাবাদ করতে দেয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ৩৭৭৩)
(২) বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন : বৃক্ষ-তরুলতা প্রকৃতির প্রাণ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। কাজেই বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করতে হবে। অপ্রয়োজনে বৃক্ষ-তরুলতাকে নষ্ট করা যাবে না। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে।’ (বুখারি, আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৭৯; মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৮৩)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে (যে গাছ মানুষের উপকার করতো) আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ (বায়হাকি, হাদিস: ১৪০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃক্ষরোপণ করতে উত্সাহ দিয়েছেন। এটিকে সাদকা হিসেবে উলেস্নখ করেছেন। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে মুসলমান কোনো বৃক্ষ রোপণ করে, তারপর তা থেকে কোনো মানুষ, পশু বা পাখি ভক্ষণ করে, এর বিনিময়ে কেয়ামতে তার জন্য একটি সদকার সাওয়াব রয়েছে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪০৫৩)
(৩) প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার : জীবন ধারণের মূল উপাদানসমূহকে মহান আল্লাহ সহজ করে দিয়েছেন। যেমন— পানি, বাতাস ইত্যাদি। এসবের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সহজলভ্য বলে অপচয় ও অপব্যবহার করা যাবে না। বর্ষায় চারিদিকে পানি বেড়ে গেলেও পানির অপচয় ও অপব্যবহার রোধ করতে হবে। অপচয় সবসময়ই নিষেধ। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) সাদ (রা.)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যখন তিনি অজু করছিলেন। রাসুল (সা.) বললেন, ‘কেন এই অপচয়?’ সাদ (রা.) বলেন, অজুতেও কি অপচয় হয়?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, এমনকি প্রবাহিত নদীতে অজু করলেও।’ (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ৪২৫)
(৪) জীব-জন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা পরিহার : জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার জন্য জীববৈচিত্র ধ্বংস অনেকাংশে দায়ী। এজন্য বন্য ও গৃহপালিত পশু-পাখির প্রতিও ভালোবাসা প্রদর্শন ও দয়াশীল আচরণ করতে হবে। কোনো প্রাণির প্রতি নিষ্ঠুর অচরণ করা যাবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! জীব-জন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শনের জন্যও কি আমাদের পুরষ্কার আছে? রাসুল (সা.) বলেন, ‘হ্যাঁ। প্রত্যেক দয়াদ্র হূদয়ের অধিকারীদের জন্য পুরস্কার আছে।’ (বুখারি, হাদিস: ৫৬৬৩)
(৫) বায়ু দূষণ প্রতিরোধ : মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন বাতাস প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। পক্ষান্তরে দূষিত বাতাস স্বল্প সময়ে প্রকৃতির নির্মলতা নষ্ট করে দেয়। বায়ু দূষণের ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, পরিবেশ ও সম্পদ নষ্ট হয়। এর ফলে বায়ুম্ললে ওজন সত্মর পাতলা হয়ে যায়। এসব বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হয়। বায়ুকে দূষণ মুক্ত রাখতে ইসলামের যথেষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। যেমন—
(ক) উন্মুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগ না করা : মুআজ ইবন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা অভিশাপ ডেকে আনে এরূপ তিনটি কাজ থেকে বিরত থাকো। চলাচলের রাস্তায়, রাস্তার মোড়ে অথবা ছায়াদার স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করা থেকে।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ২৬)
(খ) বর্জ্য মাটিতে পুঁতে ফেলা : কেউ মারা গেলে তাড়াতাড়ি তাকে কবর দিতে হয়। ময়লা-অবর্জনা, মরা-পঁচা ও দুর্গন্ধময় বস্তুকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়। কোরআন থেকেই এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন— আদম (আ.) এর পুত্র কাবিল যখন তার ভাই হাবিলকে হত্যা করে তখন দুটি কাক সেখানে এসে তাদের একজন আরেকজনকে হত্যা করে এবং মৃত কাককে মাটিতে দাফন করে। এটি দেখে কাবিল মাটি দিয়ে মৃত হাবিলকে ঢেকে দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহ এক কাক পাঠালেন, যে তার ভাইয়ের শবদেহ কিভাবে গোপন করা যায় তা দেখাবার জন্য মাটি খনন করতে লাগল।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৩১)
নবী (সা.) যখন সিংগা দিতেন অথবা লোম পরিষ্কার করতেন, নখ কাটতেন তখন তিনি তা বাকিউল গারকাদ কবরস্থানে পাঠাতেন, তারপর তা পুঁতে ফেলা হতো। (আখলাকুন নবী, পৃ. ৩৫৯)
(গ) দুর্গন্ধ পরিহার : জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাঁচা পেঁয়াজ খাবে, সে যেন আমাদের থেকে অথবা আমাদের মসজিদ থেকে দূরে থাকে এবং ঘরে বসে থাকে।’ (বুখারি, হাদিস: ৫৪৫২)
(ঘ) সুগন্ধি ছড়ানো : সুগন্ধি ছড়ানো এবং অন্যকে তা উপহার দেওয়া পরিবেশ উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। এজন্য সুগন্ধির আদান-প্রদানে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘যার সামনে সুগন্ধি উপস্থাপন করা হয় সে যেন তা প্রত্যাখ্যান না করে। কারণ তা বহনে হালকা এবং বাতাসকে সুবাসিত করে।’ (মুসলিম, হাদিস: ৫৮৩৫)
অবশ্য আত্মিক ক্ষতি রোধে নারীদের সুগন্ধি ব্যবহার করে বহির্গমণ করতে বারণ করা হয়েছে। আবু মুসা আল-আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে কোনো মহিলা সুগন্ধি বা পারফিউম ব্যবহার করে, অতঃপর মানুষের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে, যাতে তারা তার সুবাস পায় সে একজন ব্যভিচারিণী।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৭৮৬)
(ঙ) হাঁচি ও কাশি দেওয়ার সময় মুখ ঢেকে রাখা : হাঁচি-কাশির মাধ্যমে নির্গত ময়লা ও জীবাণু দ্বারা অন্যরা আক্রান্ত হতে পারে। এজন্য হাঁচি ও কাশি দেওয়ার সময় মুখ ঢেকে রাখতে হয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) যখন হাঁচি দিতেন তখন এক টুকরা কাপড় বা নিজ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলতেন এবং নিম্ন আওয়াজ করতেন। (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯৪৫)
(৬) পানি দূষণ প্রতিরোধ : পানি ছাড়া প্রাণির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সেজন্য পানিকে নিরাপদ ও দূষণমুক্ত রাখতে হবে। নিজেদের কোন কর্মে যেন পানি দূষিত না হয় সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) পানিকে পবিত্র, নিরাপদ ও দূষণমুক্ত রাখতে সবাইকে সচেতন করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন আবদ্ধ পানিতে প্রসাব করে অতঃপর সেখানে গোসল না করে।’ (বুখারি, হাদিস: ২৩৬; মুসলিম, হাদিস : ৬৮২)
পরিশেষে বলা যায়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ইসলামের নির্দেশনাগুলোর সফল বাসত্মবায়ন বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। এভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়ে পৃথিবী আবারো বাসযোগ্য হতে পারে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।