করোনাভাইরাসের অতিমারির ভয়াবহ দিনগুলো পেরিয়ে গেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভাইরাসটির নতুন উপধরন নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। আবার বেশ কয়েক বছর ধরেই বর্ষা এবং বর্ষা–পরবর্তী মৌসুমে আতঙ্ক হয়ে উঠছে ডেঙ্গু জ্বর। এটিও ভাইরাসজনিত রোগ। এ বছর একই সময়ে দুটি ভিন্ন ধরনের ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। তাই একই সঙ্গে দুটি ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
রাজধানীর ধানমন্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মেডিসিন কনসালট্যান্ট ডা. সাইফ হোসেন খান জানালেন, একই সঙ্গে এই দুটি ভাইরাসের সংক্রমণ হলে জটিলতার ঝুঁকি বাড়ে। তাই এ ধরনের রোগীর প্রতি যত্নশীল হওয়া আবশ্যক। রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করানোটাই সবচেয়ে নিরাপদ। এমন সংক্রমণ যেন না হয়, সে বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, এই চিকিৎসকের কাছ থেকেই সে বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
করোনা নাকি ডেঙ্গু?
একই সঙ্গে এই দুই ভাইরাসের সংক্রমণ হলে দেখা দিতে পারে তীব্র জ্বর। ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি জ্বর আসতে পারে। জ্বর থাকতেও পারে বেশ কিছু দিন। জ্বর ছাড়তে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই সপ্তাহের বেশি সময়ও লেগে যেতে পারে। মাথাব্যথা, অত্যধিক তৃষ্ণা, গলাব্যথা, পেশির ব্যথা, গিঁটে ব্যথা, বুকে চাপ, শ্বাসকষ্ট, কাশি, ক্ষুধামন্দা, বমিভাব, বমি, শারীরিক দুর্বলতা আর অত্যধিক ক্লান্তিও এই দ্বৈত সংক্রমণের উপসর্গ। তা ছাড়া শ্বাসের গতি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়েও যেতে পারে। দেখা দিতে পারে ঘুমের সমস্যা। করোনার সংক্রমণ ও ডেঙ্গু জ্বরের অন্যান্য উপসর্গও দেখা দিতে পারে।
কেন ঝুঁকি বেশি দ্বৈত সংক্রমণে
দেহে যেকোনো জীবাণু প্রবেশ করলে শত্রুকে ঘায়েল করতে দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা অকুতোভয় সৈন্যের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। সৈন্যের উদাহরণটি রূপক হিসেবে দেওয়া হলেও এ কিন্তু আদতে এক ‘যুদ্ধ’ই বটে। আপনার সুস্থতার জন্য লড়াই করে আপনারই দেহকোষ। জীবাণুরাও ‘যুদ্ধের ময়দান’ অর্থাৎ আপনার দেহখানা ছেড়ে যেতে চায় না। এই ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ার ফলেই আপনার দেহে দেখা দেয় সংক্রমণের বিভিন্ন উপসর্গ। শত্রু যদি হয় দুই ধরনের অর্থাৎ যদি হয় দ্বৈত সংক্রমণ, তখন লড়াইটাও হয় তুমুল। তাই দেহের ওপর এত সব ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ার প্রভাবটাও পড়ে বেশি। দেহের রক্ষণব্যবস্থার সৈনিক শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যাও অনেকটাই কমে যেতে পারে।
যেসব জটিলতা দেখা দেয়
দ্বৈত সংক্রমণ হলে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফুসফুস, কিডনি, হৃৎপিণ্ড, লিভার, এমনকি মস্তিষ্কেরও ক্ষতি হতে পারে। রক্তক্ষরণের প্রবণতা বাড়ে। বুকে বা পেটে পানি জমা হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যেতে পারে, হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যেতে পারে অস্বাভাবিকভাবে, রক্তচাপও অনেক কমে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিকে বলা হয় ‘শক’। এ ধরনের জটিলতা প্রাণঘাতী রূপ নিতে পারে। জটিলতা বেশি বলেই দ্বৈত সংক্রমিত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। হাসপাতালে থাকতেও হতে পারে লম্বা সময়। অবস্থা বেগতিক হলে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়ারও প্রয়োজন হতে পারে।
দ্বৈত সংক্রমণ হলে কাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি
ডেঙ্গু জ্বর হলে শিশুদের ভোগান্তি বাড়ে; থাকে প্রাণনাশের সংশয়ও। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হলে শিশুদের ঝুঁকি তুলনামূলক কম। দ্বৈত সংক্রমণের ক্ষেত্রেও ডেঙ্গু জ্বরের জটিলতাগুলোতেই ভুগতে পারে শিশুরা। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির দ্বৈত সংক্রমণ হলে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তরুণেরাও খুব একটা ঝুঁকিমুক্ত নন। বিশেষত যেকোনো বয়সী স্থূল ব্যক্তিই দ্বৈত সংক্রমণের ক্ষেত্রে বাড়তি ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাজমা, হৃদ্রোগ ও দীর্ঘমেয়াদি অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এ ধরনের সংক্রমণ হলে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। গর্ভবতী নারীর দ্বৈত সংক্রমণ হলে গর্ভের সন্তানও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
কী করবেন?
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বা ডেঙ্গু জ্বরের যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে, রোগীর ঠিক কী ধরনের সংক্রমণ হয়েছে। যেকোনো জ্বরেই পানি ও তরল খাবার খেতে হবে পর্যাপ্ত। রোগীর মাথা ও শরীর মুছিয়ে দিতে হবে ভেজা কাপড় দিয়ে। জ্বরের রোগীর গোসল করাও ভালো। তবে স্বস্তি পেতে গোসলের পানিতে সামান্য পরিমাণ গরম পানি মিলিয়ে নিতে পারেন। জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল খান। ব্যথার অন্য কোনো ওষুধ খাওয়া থেকে অবশ্যই বিরত থাকুন। আগে থেকে যদি অ্যাসপিরিন, ক্লপিডগ্রেল, ওয়ারফেরিন বা এ ধরনের কোনো ওষুধ খেয়ে থাকেন, যা রক্তকে তরল রাখতে সাহায্য করে, তাহলে সেটি চিকিৎসককে অবশ্যই জানাবেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের উপসর্গ দেখা দিলে একটি আলাদা ঘরে থাকাই ভালো। পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর চিকিৎসকই আপনাকে পরবর্তী নির্দেশনা দেবেন। শুরু থেকেই মাস্ক ব্যবহার করুন।
সচেতনতায় হোক প্রতিরোধ
এই দুটি রোগ এমন উপায়ে সংক্রমিত হয়, যেখানে কেবল ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সচেতনতা থাকলেই চলে না; বরং সামাজিক পরিসরেও হতে হয় সচেতন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে মাস্ক পরা, হাত পরিষ্কার করা, হাঁচি–কাশির আদবকেতা মেনে চলা, যেখানে–সেখানে কফ–থুতু না ফেলার মতো সাধারণ নিয়মগুলো সবারই জানা। নতুনভাবে এসব সু–অভ্যাসের চর্চা শুরু করুন। অসচেতনতায় বাড়বে সংক্রমণের ঝুঁকি। নির্দিষ্ট উপসর্গবিহীন সংক্রমণ হলে আপনি নিজেও আপনজনদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন প্রাণঘাতী ভাইরাস। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে মশা থেকে সুরক্ষিত থাকার ব্যাপারে অনেকেই সচেতন। তবে এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এলাকার বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি। এই যেমন শহুরে এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের পানিতে মশার বংশবিস্তারের ঝুঁকি বাড়ে। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই এই পানিনিষ্কাশন করা হয় না। তাই রোগ প্রতিরোধে সামাজিক পরিসরে সবার সচেতনতার বিকল্প নেই। বাসায় গাছপালার টবে যাতে পানি না জমে থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখুন।