শায়খ আবদুর রহীম ছিলেন লেখক, গবেষক, শিক্ষক ও সংস্কারক। তিনি ১ মে ১৯০৪ ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত ‘জঙ্গিপুর’ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মুহাম্মাদ ইয়াকুব মোল্লা। শায়খ আবদুর রহীম প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা নিজ পরিবারে অর্জন করেন। অতঃপর শামসুল উলামা আবূ নসর ওহীদ-এর উদ্ভাবিত ‘নিউস্কিম’ পদ্ধতিতে পরিচালিত জঙ্গিপুর হাই মাদরাসায় ভর্তি হন। এই মাদরাসা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে হুগলী চলে যান। সেখানের নিউস্কিম মাদরাসায় (বর্তমান নাম হাজী মুহসীন কলেজ) মাধ্যমিক শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে ভর্তি হন। এ মাদরাসায় থাকা অবস্থায় তিনি মাতৃভাষার পাশাপাশি আরবি, উর্দু, ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে জেনারেল বিষয়গুলোর মধ্যে গণিত, দর্শন ও ইতিহাসেও দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি ১৯১৯ সালে মেট্রিকুলেশন এবং ১৯২৪ সালে ঢাকার ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ আই.এ পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হন। এ বিভাগ থেকে ১৯২৮ সালে বি.এ অনার্স এবং ১৯২৯ সালে ডিগ্রি অর্জন করেন।
শায়খ আব্দুর রহীম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ইলমে হাদিস ও তাফসির শাস্ত্রে ব্যুত্পত্তি অর্জনের জন্য তাকে পৃথিবী বিখ্যাত দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’-এ প্রেরণ করা হয়। সেখানে ১৯৪০-৪৩ সাল পর্যন্ত শিক্ষারত থাকেন। সমাপনী পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করে মহান শিক্ষকদের মন জয় করতে সক্ষম হন। ফলে দেওবন্দ মাদরাসার নিয়মানুসারে ফাজেলে দেওবন্দ হিসেবে তাকে সনদ প্রদান করেন। দারুল উলুম দেওবন্দে তাঁর বিখ্যাত শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন আল্লামা সাইয়েদ হুসাইন আহমাদ মাদানি, ইবরাহিম বলিয়াবী, ইজাজ আলী, মুফতী শফী ও শাব্বির আহমাদ উসমানী (রহ.) প্রমুখ।
শায়খ আব্দুর রহীম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে ১৯৩০ সালে স্বল্প সময়ের জন্য ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৯ সালের শুরুর দিকে ‘জঙ্গিপুর হাই মাদরাসা’ (নিউস্কিম) এর সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার ডাক পেলে তিনি এ চাকরিটি ছেড়ে দেন এবং ১৯৩৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এ পদে থাকাবস্থায়ই মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাকে দারুল উলুম দেওবন্দে জ্ঞানার্জনের জন্য পাঠানো হয়।
দেওবন্দ থেকে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপদে পুনরায় শিক্ষকতার জীবন শুরু করেন। অতঃপর ১৯৪৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পদোন্নতি পেয়ে ‘মাওলানা’ পদে উন্নীত হন। ১৯৬৯ সালের ১ জুন সিনিয়র প্রভাষক পদে উন্নীত হন এবং ৩০ জুন ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। ১৯৭০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর শায়খ আব্দুর রহীম চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
শায়খ আবদুর রহীম ১৯৫১ সালে ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ‘জমিয়তে উলামায়ে পাকিস্তানের সেক্রেটারি জেনারেল নিযুক্ত হন। সে সময় উক্ত সংগঠনের সভাপতি ছিলেন মাওলানা আতহার আলী (রহ.)।
শায়খ আবদুর রহীম একজন খ্যাতিমান লেখক ছিলেন। তিনি ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
১. ‘তাজরীদুল বুখারী’-এর ১ম খন্ডের অংশ বিশেষ অনুবাদ করেন।
২. ইমাম তিরমিযীর শামায়েল-ই-তিরমিজির প্রথমার্ধের বাংলা অনুবাদ করেন এবং এর টীকায় সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলোর বরাত, রাবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও কঠিন শব্দগুলোর বিশ্লেষণ করেন।
৩. আরবি ব্যাকরণ ও আরবি সাহিত্য (মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড)
৪. ‘বুলুগুল মারাম’ হাদিস গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা।
৫. রমজান ও তাসাওউফ
৬. মসজিদের ইমামের শিক্ষার মান, তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
তিনি ২৯ এপ্রিল ১৯৭৩ রবিবার ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৯ বছর।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা