সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় প্রকৃত উপকারভোগী নির্বাচন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। মাঠপর্যায়ে অনেক জনপ্রতিনিধি না থাকায় প্রকৃত ভাতাভোগীদের তালিকা চূড়ান্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। কারণ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে অনেক জনপ্রতিনিধি পলাতক।
নতুন তালিকা চূড়ান্ত না হওয়ায় চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না। সাধারণত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ১ কোটি ২১ লাখ উপকারভোগী ভাতা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত কেউ ভাতা পাননি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বাজেটে ভাতাভোগীদের জন্য ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
ভাতাভোগীর তালিকা নির্ধারণে যে নীতিমালা তাতে বলা হয়েছে, প্রতিটি ভাতা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। কমিটিতে জনপ্রতিনিধিকে সভাপতি হিসেবে রাখা হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে এ কমিটি না থাকলে বিকল্প কী হতে পারে, তা নীতিমালায় বলা আছে। সেখানে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে সভাপতি করা আছে। কিন্তু এ তথ্য অনেকে জানেন না। ফলে উপকারভোগীর তালিকা করতে দেরি হচ্ছে। অন্যদিকে আট জেলায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) নেই। ওই জেলাগুলোতেও ভাতাভোগীদের তালিকা তৈরিতে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
তিন বছর ধরে বয়স্ক ভাতা পান গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়নের খামার বোয়ালি গ্রামের গোলাপ উদ্দিন (৬৮)। তিনি বলেন, প্রতি তিন মাস পর ১ হাজার ৮০০ টাকা পান। কখনো মাসের প্রথম সপ্তাহে, কখনো মাঝামাঝি সময় মোবাইলে টাকা আসে। চলতি মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত কোনো টাকা পাননি তিনি।
এবার সময়মতো ভাতা না পাওয়ায় অনেকে বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর উপকারভোগীদের ভাতা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, ভাতা বন্ধ করে দেওয়ার তথ্যটি গুজব। উপকারভোগীদের তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম প্রান্তিকের ভাতা ছাড় করা হবে। নভেম্বরের মধ্যে ভাতা দেওয়া হবে।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগী নির্বাচন নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ তালিকায় সচ্ছল ব্যক্তিরাও ঢুকে পড়েছেন। যাঁরা ভাতা পাওয়ার যোগ্য নন, তাঁরাও পাচ্ছেন। অথচ প্রকৃত উপকারভোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় এ রকম সচ্ছল ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে প্রকৃত উপকারভোগীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে যাঁরা এখন ভাতাভোগীর তালিকায় আছেন, তাঁরা আসলেই ভাতা পাওয়ার যোগ্য কি না, তা দেখতে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে শরীয়তপুর সদরের চন্দ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব জুয়েল পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, ভাতাভোগীদের এবারের কিস্তির টাকা এখনো দেওয়া হয়নি। জুলাই মাস থেকে তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। তাঁদের ইউনিয়নেরটা করা হয়েছে। তাঁদের চেয়ারম্যান জুলাই থেকে নেই। প্যানেল চেয়ারম্যান ও সদস্যরা মিলে বাছাই কার্যক্রম শেষ করেছেন।
সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর বয়স্কভাতা পাচ্ছেন ৬০ লাখ; মাথাপিছু মাসিক ভাতা পান ৬০০ টাকা। এ বছর বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। বিধবা ভাতা পান প্রায় ২৮ লাখ; মাথাপিছু ভাতা ৫৫০ টাকা। বাজেটে বরাদ্দ আছে ১ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পান ৩২ লাখ; মাথাপিছু ভাতা ৮৫০ টাকা। এ বছর বরাদ্দ ৩ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। হিজড়া জনগোষ্ঠীর বিশেষ ভাতা পান ১৩ লাখ; মাথাপিছু মাসিক ভাতা ৬০০ টাকা। এ বছর বরাদ্দ ৯ কোটি টাকা। বেদে জনগোষ্ঠীর ৬ হাজার জন ভাতা পান; মাথাপিছু মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা। বাজেটে বরাদ্দ সাড়ে ৩ কোটি টাকা। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বিশেষ ভাতা পান ৬০ হাজার; মাথাপিছু মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা। এ বছর বরাদ্দ ৩৬ কোটি টাকা। সাধারণত তিন মাস অন্তর উপকারভোগীদের ভাতার টাকা দেওয়া হয়।
ইউনিসেফের একটি জরিপে দেখা যায়, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীদের তালিকার ৪৩ শতাংশই ত্রুটি আছে। অর্থাৎ এঁরা ভাতা পাওয়ার অযোগ্য। অনেক সচ্ছল ব্যক্তির নাম এই তালিকায় রয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় একই ধরনের চিত্র উঠে এসেছে। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, উপকারভোগীদের মধ্যে নিজেদের বয়স্ক দাবি করা প্রায় ৩০ শতাংশ, বিধবা দাবি করা প্রায় ৩৩ শতাংশ এ ভাতা পাওয়ার অযোগ্য।
সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, ভাতাভোগীর তালিকায় সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয় বিধবা ও প্রতিবন্ধী তালিকায়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় এসব অনিয়ম হয় বলে অভিযোগ আছে। অনেকে বিধবা হওয়ার পর আবার বিয়ে করেন। অনেকে প্রতিবন্ধী না হয়েও এ তালিকায় ঢুকে গেছেন। একটি স্বচ্ছ তালিকা করার জন্যই অন্তর্বর্তী সরকার তালিকা পর্যালোচনা শুরু করে। তবে এ তালিকা তৈরি করার সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের পাশাপাশি সরকারের বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ (নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, অর্থ মন্ত্রণালয়) সম্পৃক্ত। তাই সবার মধ্যে সমন্বয় করে তালিকা চূড়ান্ত করতে সময় লাগছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ভাতাভোগীদের একটি স্বচ্ছ তালিকা তৈরির কাজ চলছে। মাঠপর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও জনপ্রতিনিধিরা না থাকায় তালিকা চূড়ান্ত করতে সময় লাগছে বেশি। তাই এবার প্রথম প্রান্তিকের ভাতা দিতে কিছুটা দেরি হচ্ছে। তবে ভাতা বন্ধ হচ্ছে বলে যা শোনা যাচ্ছে, এটা পুরোপুরি গুজব। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে তালিকা চূড়ান্ত করে ভাতা দেওয়া হবে।