জাপানের পার্লামেন্টে নিম্নকক্ষের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফলের ওপর গভীর নজর রাখছেন অনেকেই। এক দশক পর সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে বসেছে ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) জোট। বুথ ফেরত জরিপ বলছে, বিরোধী দলগুলো অর্ধেকেরও বেশি আসন পাচ্ছে। খবর বিবিসির
জাপানের জাতীয় সম্প্রচারকারী এনএইচকে জানিয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে, নিম্নকক্ষের ৪৬৫ আসনের মধ্যে ২০৮টি আসনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি জয়ী হয়েছে। আর ডেমোক্রেটিক পার্টি (সিডিপি) জয়ী হয়েছে ২৩৫ আসনে। ফল ঘোষণার বাকি আছে ২২টি আসনে।
জাপানের নিম্নকক্ষ ডায়েটে এককভাবে সরকার গঠন করতে হলে কোনো দলকে পেতে হবে ২৩৩টি আসন। নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন না পেলে সরকার গড়তে এলডিপিকে জোট সরকার গঠন বা সংখ্যালঘু সরকার পরিচালনা করতে হবে।
জাপানের সর্বোচ্চ বিরোধী দল কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (সিডিপি) নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিকো নোডা। গতকাল দুপুর দুইটা পর্যন্ত ১৪৩টি আসন সিডিপির জয়ের কথা জানায় জাপানের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এনইচকে।
গত মাসে ক্ষমতাসীন এলডিপির প্রধান নির্বাচিত হন ইশিবা। এরপর পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ভেঙে দিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ইশিবা বলেন, ভোটাররা আমাদের বিপক্ষে রায় দিয়েছেন। তাদের মতামতকে আমাদের বিনীতভাবে মেনে নিতে হবে।
বছরের শুরুতে রাজনৈতিক দলটির বিরুদ্ধে তহবিল সংগ্রহের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পায়। এরপর থেকেই এলডিপির জনপ্রিয়তা ২০ শতাংশ কমে যায়। যদিও বিরোধীরা দল গোছাতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশ চালাতে তারাই যোগ্য, এটি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। সংসদ ভেঙে দেওয়ার আগে সিপিডির জনপ্রিয়তা ছিল ৬ শতাংশ।
কেয়ার হোমে কাজ করা এলডিপি সমর্থক মিউকি ফুজিসাকি বিবিসিকে বলেন, নির্বাচনে কোন দলকে ভোট দেব। এটা বেছে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন। কারণ, আমি মনে করি, নির্বাচন নিয়ে জনগণ দিন দিন আগ্রহ হারাচ্ছে। তিনি বলেন, এলডিপির দুর্নীতির সমস্যা থাকলেও এছাড়া বিকল্প কোনো দল নেই।
এলডিপির বিরুদ্ধে বিরোধীদের বিস্তর অভিযোগ। তবে তারা কি চায় তা-ও পরিষ্কার নয়, যোগ করেন ৬৬ বছর বয়সী ফুজিসাকি।
উদাসীনতার ফলে জাপানে রাজনীতি খুব দ্রুত গতিতে চলছে। ফুমিও কিশিদার উত্তরসূরী শিগেরু ইশিবা। কিশিদা ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দলীয় প্রধান হওয়ার পর এলডিপির আর্থিক কেলেঙ্কারি সামাল দিতে পদক্ষেপ নেন ইশিবা। এই পদক্ষেপ ভোটারদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা মনে করছেন, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী অনেক নেতাকে এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে প্রতিরক্ষা নীতি নিয়ে তার কিছু অসংযত মন্তব্যও অনেকের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নাগরিকদের সমর্থনের হার দ্রুত হ্রাস পাওয়া লক্ষ করা গেছে।
এমন অবস্থায় আজকের ভোটের ফলাফলের মধ্য দিয়ে ইশিবা নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারবেন কি না, তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন। ফলে এ রকম সম্ভাবনা ক্রমে বাড়ছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনিই হতে পারেন সবচেয়ে কম সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা জাপানের প্রধানমন্ত্রী।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর হিগাশিকুনি নারুহিরো মাত্র ৫৪ দিন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অপর দিকে ইশিবা দায়িত্ব গ্রহণের ২৬ দিন পর আজকের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচনের ফলাফলের আলোকে তাকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হলে হিগাশিকুনির আগের রেকর্ড তিনি হয়তো ভেঙে দেবেন।
ইশিবাকে ক্ষমতা থেকে সরে গেলেও এলডিপির পতনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, আসনসংখ্যা হ্রাস পেলেও দলটি সরকার গঠন করতে সক্ষম হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর প্রধান কারণ, বিরোধী শিবিরের দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাব।
প্রধান বিরোধী সাংবিধানিক গণতন্ত্রী (সিডিপি) দল গত নির্বাচনের মতো জাপানের কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্য কয়েকটি দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না। ফলে অন্য দলগুলো অনেক আসনে নিজেদের প্রার্থী দাঁড় করানোয় এদের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি হয়ে গেলে উদার গণতন্ত্রীরা এতে লাভবান হবে।
জাপানের স্থানীয় সময় রোববার সকাল ৭টায় শুরু হওয়া ভোট গ্রহণ রাত ৮টা পর্যন্ত চলে। নির্বাচনে ২ কোটি ৯ লাখ ৫৫ হাজার ভোটার ভোট দিয়েছেন। ২০২১ সালের পূর্ববর্তী নির্বাচনের চেয়ে এই সংখ্যা ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি। আজ সোমবার গভীর রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হতে পারে।
ভোট গ্রহণ শেষে প্রায় অর্ধেক আসনের ফলাফল প্রকাশ করেছে জাপানের প্রভাবশালী দৈনিক আসাহি শিম্বুন। এতে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন জোট পেয়েছে ২১৫টি আসন। আর বিরোধী দলগুলোর সম্মিলিত আসনসংখ্যা ২৩৫; অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছে বিরোধীরা। তবে বিরোধীদের এই সম্মিলিত আসনসংখ্যার মধ্যে ছয়টি দলের প্রতিনিধিত্ব থাকায় ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ এদের জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এখন পর্যন্ত সিডিপির আসনসংখ্যা ১৪৮।
আসাহি শিম্বুনের বুথফেরত জরিপের ফলাফল বলছে, এলডিপি-কোমেই পার্টির ক্ষমতাসীন জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখার মতো পর্যাপ্ত আসন পাবে না। তবে সবকিছু অবশ্য নির্ভর করবে এখন পর্যন্ত ভোট গণনা শেষ না হওয়া আসনের ফলাফলের ওপর।
এদিকে জাপানের রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে বলছে, বুথফেরত জরিপ ও নিজস্ব বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না।
অনেকে আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। কয়েকজন জয়ীও হয়েছেন। দল হয়তো এঁদের এখন ফিরিয়ে নেবে। ফলে সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সম্ভবত তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন। তবে এলডিপির পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখা সম্ভব হলেও ইশিবার ভাগ্যের বদল হবে বলে মনে হয় না।